টেনিদা : বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য চরিত্র HS BENGALI PROJECT : TENIDA

by - August 29, 2019

HS BENGALI PROJECT : TENIDA

টেনিদা : বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য চরিত্র 



টেনিদার স্রষ্টা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য অমূল্য কিছু রত্ন-ভাণ্ডার রেখে গেছেন। রত্নের সেই ভাণ্ডারে টেনিদা যেন এক কোহিনূর। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের আসল নাম কিন্তু নারায়ণ নয়, তারকনাথ। লেখালেখিতে এসে নিজেই নিজের গোল্ডমেডেল পাওয়া নাম বদলে রেখেছিলেন। তার সৃষ্টি টেনিদা লেখাপড়ায় খারাপ হলেও নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নিজে কিন্তু বেশ ভালো ছাত্র ছিলেন। জন্মেছিলেন বাংলাদেশের দিনাজপুরে। স্নাতোকত্তোরে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে শিক্ষকতায় মন দিলেন।

তিনি শুধু একজন সফল লেখকই নন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্রের শ্রদ্ধার শিক্ষকও বটে। সব ছাত্রের মাঝে একজন ছাত্র নারায়ণের খুব পছন্দের ছিল। শুধু অভিনয় নয়, আবৃত্তির গলাও অসাধারণ, তাল মিলিয়ে করে বামপন্থী রাজনীতি। অভিনয় শেষে ছাত্রটি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত ধরে জিজ্ঞাসা করতেন অভিনয় তার পছন্দ হয়েছে কিনা। শিক্ষক তাকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করতেন, একদিন বিখ্যাত অভিনেতা হবে তার ছাত্র। ছাত্রটি আর কেউ নয়, সৌমিত্র চট্টপাধ্যায়। তার পটলডাঙার বাসায় ছাত্রেরা এসে আড্ডা দিত, ছাত্রদের তালিকায় ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অমিতাভ দাশগুপ্ত, নির্মাল্য আচার্য্যের মতো ব্যক্তিত্বরা।

১৯৪৬ সালের দিকে স্ত্রী আশা দেবীর সাথে পটলডাঙায় এসে ওঠেন। বাড়িওয়ালার ছেলে ছিল প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। তাকে দেখেই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মাথায় আসে টেনিদার কথা। তাকে টেনিদা কল্পনা করে লিখে ফেলেন ‘খট্টাঙ্গ ও পলান্ন’। আর পায় কে? এর মাধ্যমেই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সৃষ্টি করে ফেললেন এক অমর চরিত্র। শিশু-কিশোর সাহিত্যিক হিসেবে বাড়তে লাগল নামডাক। ১৯৯৫ সালে ২৫ সেপ্টেম্বর আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। তার কথায় উঠে এসেছিল বাস্তব টেনিদা আর গল্পের টেনিদার ফারাক। আসে মিল এবং লেখক সম্পর্কে স্মৃতিচারণ।



চরিত্র:-
টেনিদা মূলত উত্তর কলকাতার পটলডাঙায় বসবাসরত একটি স্থানীয় চরিত্র। টেনিদার প্রকৃত নাম ভজহরি মুখার্জি। পটলডাঙার আশেপাশে ​​বসবাসরত চার তরুণ ছেলেদের একটি দলের নেতা টেনিদা পড়াশোনায় তেমন ভালো ছিলেন না। সাত বারের চেষ্টাতে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করেছিলেন তিনি। টেনিদা বিখ্যাত ছিলেন তার খাঁড়ার মত নাকের জন্যে, গড়ের মাঠে গোরা পেটানোর জন্যে। আর তার বিখ্যাত সংলাপ, "ডি-লা গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস ইয়াক ইয়াক"। টেনিদা সম্বন্ধে গল্পলেখক প্যালারাম লিখেছেন, "টেনিদাকে নইলে আমাদের যে একটি দিনও চলে না। যেমন চওড়া বুক - তেমনি চওড়া মন।" "পাড়ার কারও বিপদ-আপদ হলে টেনিদাই গিয়ে দাঁড়িয়েছে সকলের আগে। লোকের উপকারে এক মুহুর্তের জন্য তার ক্লান্তি নেই - মুখে হাসি তার লেগেই আছে। ফুটবলের মাঠে সেরা খেলোয়াড়, ক্রিকেটের ক্যাপ্টেন। আর গল্পের রাজা। এমন করে গল্প বলতে কেউ জানে না।"

টেনিদা গল্প মূলত দুই ধরণের, (ক) টেনিদা তাঁর তথাকথিত বীরত্বের বানানো গল্প বর্ণনা করেন।[১] (খ) টেনিদা ও প্যালা[২] বা চার তরুণ দলের অত্যধিক উল্লসিত অ্যাডভেঞ্চারের আকর্ষণীয় এবং শেষে রহস্যময় পরিস্থিতি মাধ্যমে সমাধানের গল্প বর্ণনা।[৩] এই সিরিজের ছোটগল্পগুলি ব্যাপকভাবে কলকাতার উপর ভিত্তি করে রচিত।

টেনিদা : ৫ টি কালজয়ী উপন্যাস 
চার মূর্তি
চার মূর্তির অভিযান
কম্বল নিরুদ্দেশ
টেনিদা আর সিন্ধুঘোটক
ঝাউ-বাংলোর রহস্য

এছাড়াও টেনিদার ওপর লেখা বিভিন্ন ছোট গল্প গুলি হলো :-
একটি ফুটবল ম্যাচ
দধীচি, পোকা ও বিশ্বকর্মা
খট্টাঙ্গ ও পলান্ন
মৎস্য-পুরাণ
পেশোয়ার কী আমীর
কাক-কাহিনী
ক্রিকেট মানে ঝিঁঝিঁ
পরের উপকার করিও না
চেঙ্গিস আর হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা
ঢাউস
নিদারুণ প্রতিশোধ
তত্ত্বাবধান মানে-জীবে প্রেম
দশাননচরিত
দি গ্রেট ছাঁটাই
ক্যামোফ্লেজ
কুট্টিমামার হাতের কাজ
সাংঘাতিক
বন-ভোজনের ব্যাপার
কুট্টিমামার দন্ত কাহিনী
প্রভাতসঙ্গীত
ভজহরি ফিল্ম কর্পোরেশন
চামচিকে আর টিকিট চেকার
ব্রহ্মবিকাশের দন্তবিকাশ
টিকটিকির ল্যাজ
বেয়ারিং ছাঁট
কাঁকড়াবিছে
হনোলুলুর মাকুদা
হালখাতার খাওয়াদাওয়া
ঘুঁটেপাড়ার সেই ম্যাচ
টেনিদা আর ইয়েতি
একাদশীর রাঁচি যাত্রা
ন্যাংচাদার হাহাকার
ভজগৌরাঙ্গ কথা



গল্প ও বাস্তবতা 
বিখ্যাত সেই রোয়াকটা চাটুজ্যেদের ছিল না, মুখার্জীদের ছিল। হাবুল আর ক্যাবলা ছিল প্রভাতকুমারের দুই দূরসম্পর্কের ভাই। 'হাবু’, আর ‘ক্যাবলা’ নাম সেখান থেকেই ধার করা। আর পালের আরেক সদস্য প্যালা তো লেখক নিজেই! লেখককে কিন্তু হাবুল সেনের সাথেও তুলনা করা যায়, দুজনের আদিনিবাস বাংলাদেশ, লেখাপড়াতেও ভালো। প্রভাতকুমারের স্ত্রীর ভাষায়, যে লেখক নিজের নাম তারকনাথ থেকে বদলে নারায়ণ করেছেন, তিনি আর এতটুকু বদল আনতে পারবেন না কেন?

প্রভাতকুমারের সাথে টেনিদার মিল অমিল আসলে কোথায়? একই বাড়িতে থাকার দরুন প্রায়ই আড্ডা দিতেন লেখক আর তিনি। তখন গল্পে গল্পে যেসব কথা হতো, সেসবকিছুর তিলকে নিজের কল্পনাশক্তিতে তাল বানিয়ে ছাড়তেন লেখক। যেমন একবার গল্পের সময় প্রভাতকুমার বলেছিলেন, ছোট থাকতে তিনি হাড়সর্বস্ব ছিলেন। ঢাউস এক ঘুড়ি উড়াতে গিয়ে বেজায় নাজেহাল হতে হয়েছিল তাকে সেবার। লেখক এই সূত্র ধরে লিখে ফেললেন ‘ঢাউস’। গল্পে বিশালাকার এক ঘুড়ি টেনিদাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। এক ম্যাচে বত্রিশটা গোল দেওয়া পটলডাঙা থান্ডার ক্লাবের টেনিদার মতো ফুটবল খেলতে পারেননি প্রভাতকুমার। একবার ধরেবেঁধে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল খেলোয়াড়ের অভাবে, বাকিটা ইতিহাস।

টেনিদা : বর্তমান সময়ে প্রাসঙ্গিকতা 
প্রতিদিন নতুন নতুন বাড়ি উঠছে আমাদের শহরে, গ্রামে। ছেলেবেলায় দেখা মাঠগুলো ভরে যাচ্ছে দালানকোঠায়। বড় বড় শহরগুলোতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে পারাটাও একটা সৌভাগ্যের মতো। নতুন প্রজন্মের শিশু কিশোর হাটে ডাংগুলির বদলে তুলে নিচ্ছে স্মার্টফোন অথবা গেমিং কনসোল। প্রযুক্তির যুগে সেগুলোর একেবারে প্রয়োজন যে নেই তা নয়। কিন্তু বিকেলগুলো হতে পারতো ঘাসফড়িংয়ের। অথবা সন্ধ্যা হবার আগে, মায়ের বকুনি খেয়ে ক্লাসের পড়া পড়তে বসার আগে শেষ বিকেলের আলোতে তাড়াহুড়ো করে প্রিয় একটা বই পড়তে চেষ্টা করার।

উলটো তাদের সারাদিন কাটছে ক্লাসে, টিউশনে, অসুস্থ প্রতিযোগিতায় বা প্রশ্ন কেনার লাইনে। আমাদের বিকেলগুলো কাটছে স্ক্রিনের আলোক রশ্মিকে চোখের আরো কাছে টেনে নেওয়ায়। পরিবর্তন আমরাই আনতে পারি। শিশুকে, ভাই-বোনকে হাতে তুলে দিতে পাড়ি টেনিদা সমগ্রের মতো বই। নির্ভেজাল আনন্দ, নির্দোষ গালগল্প, আর সাহসী অভিযান তাকে বইয়ের জগতের দিকে টেনে আনবে নিঃসন্দেহে।

To be continued.................

You May Also Like

0 comments