বাংলা প্রকল্প : পুঁইমাচা গল্পের নাট্যরূপ।
উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রকল্প : পুঁইমাচা গল্পের নাট্যরূপ।
চরিত্রবর্গ :-
সহায়হরি
অন্নপূর্ণা
ক্ষেন্তি
পুঁটি
রাধী
কালীময়
সদ্য বিবাহিত পাত্র
ঠানদিদি
কয়েকজন গ্রামবাসী
বিষ্ণু সরকার
প্রথম দৃশ্য :-
মঞ্চসজ্জা : মঞ্চে একটি সাধারণ গ্রামীণ পরিবারের দৃশ্য ফুটিয়ে তুলতে হবে। মঞ্চে সর্বপ্রকার আধুনিকতা বর্জন করতে হবে। একটি তক্তপোশ বা খাটিয়া , দড়ির উপর ইতস্ততঃ জামা - কাপড় মেলা আছে। সাধারণ কিছু আসবাব এদিক - ওদিক ছড়িয়ে আছে। অন্নপূর্ণা মাটিতে বসে চুলে তেল মাখছেন। সহায়হরি মঞ্চে প্রবেশ করলেন।
সহায়হরি ( স্ত্রী অন্নপূর্ণার উদ্দেশ্যে ) : একটা বড় বাটি কি ঘটি যা হয় কিছু দাও তো , তারক খুড়ো গাছ কেটেছে , একটু ভাল রস আনি।
[ অন্নপূর্ণা সহায়হরির দিকে বড় বড় চোখ করে রাগত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন এবং নিজের চুল বাঁধতে শুরু করলেন ; কিন্তু সহায়হরির আদেশ পালন করার জন্য কোনো উদ্যোগ দেখালেন না। ]
সহায়হরি : কি হয়েছে , বসে রইলে যে ? দাও না একটা ঘটি ! আঃ , ক্ষেন্তি - টেন্তি সব কোথায় গেল এরা ? তুমি তেল মেখে বুঝি ছোঁবে না ?
[ অন্নপূর্ণা হঠাৎ করে চুল বাঁধা থামিয়ে আবার সহায়হরির দিকে প্রচন্ড রাগত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। কিছুক্ষন কোনো কথা বললেন না। তাঁর এই রূপ দেখে সহায়হরি একটু যেন ঘাবড়ে গেলেন। ]
অন্নপূর্ণা : ( শান্ত কিন্তু তীক্ষ্ণ স্বরে ) - তুমি মনে মনে কী ঠাউরেছ বলতে পার ?
সহায়হরি : ( থতমত খেয়ে এবং আমতা আমতা করে ) - কেন ......... কি আবার .......... কি ........
অন্নপূর্ণা : দেখ , রঙ্গ কোরো না বলছি। ন্যাকামি করতে হয় অন্যসময় কোরো। তুমি কিছু জান না ? কি খোঁজ রাখ না ? অত বড় মেয়ে যার ঘরে , সে মাছ ধরে আর রস খেয়ে দিন কাটায় কি করে তা বলতে পার ? গাঁয়ে কি গুজব রটেছে জান ?
সহায়হরি ( আশ্চর্য হয়ে ) : কেন ? কী গুজব ?
অন্নপূর্ণা ( মুখ ঝামটা দিয়ে ) : কী গুজব জিজ্ঞাসা করো গিয়ে চৌধুরীদের বাড়ি। কেবল বাগদী , দুলে পাড়ায় ঘুরে ঘুরে জন্ম কাটালে ভদ্দরলোকের গাঁয়ে বাস করা যায় না। সমাজে থাকতে হলে সেই রকম মেনে চলতে হয়। [ কিছুক্ষণ নিজের চুল নিয়ে আবার ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন ] একঘরে করবে গো , আমাদের একঘরে করবে। কাল চৌধুরীদের চন্ডীমন্ডপে এসব কথা হয়েছে।
সহায়হরি : তাই না'কি !
অন্নপূর্ণা : আশীর্বাদ হয়ে মেয়ের বিয়ে হলো না ............ ও নাকি উচ্ছুগ্গু করা মেয়ে ............ গাঁয়ের কোন কাজে তোমাকে আর কেউ বলবে না ........... যাও ভালোই হয়েছে তোমার। এখন গিয়ে দুলে বাড়ি , বাগদী বাড়ি উঠে - বসে দিন কাটাও।
সহায়হরি ( তাচ্ছিল্যের স্বরে ) : এই ! আমি বলি , না জানি কী ব্যাপার ! একঘরে ! একঘরে করবে ওই কালীময় ঠাকুর ! ওঃ !
অন্নপূর্ণা ( তেলে - বেগুনে জ্বলে উঠে ) : কেন , তোমাকে একঘরে করতে বেশি কিছু লাগে নাকি ? তুমি কি সমাজের মাথা , না একজন মাতব্বর লোক ? চাল নেই , চুলো নেই , এক কড়ার মুরোদ নেই , চৌধুরীরা তোমায় একঘরে করবে তা আর এমন কঠিন কথা কি ?
[ একটু গলা নামিয়ে ] ক্ষেন্তির বয়স তো পনের বছর হল ; বাইরে কমিয়ে বলে বেড়ালে কি হবে , লোকের চোখ নেই ?
[ পুনরায় মুখ ঝামটা দিয়ে ] না আছে বিয়ে দেবার গা , না কিছু ! আমি কি যাব পাত্তর ঠিক করতে ?
সহায়হরি : বলি , তোমার কি বুদ্ধি হরে গেছে ? কালীময় যে পাত্র ঠিক করে দিয়েছিল তার কথা মনে নেই ? বলি , বিয়ে কি আমি সাধ করে ভেঙে দিয়েছি ? সেই পাত্র এক কুম্ভকার বধূ ও তার আত্মীয় স্বজনদের হাতে বেদম প্রহার খেল। এমন দুশ্চরিত্র পাত্রের সঙ্গে কি কেউ মেয়ের বিয়ে দেয় ?
[ এরপর সহায়হরি নিজেই একটু এগিয়ে এসে একটি বড় বাটি নিয়ে নিলেন। ]
সহায়হরি : যাই , এই বড় বাটি ভর্তি রস আনিগে।
[ এমন সময় ক্ষেন্তি , পুঁটি ও রাধী প্রবেশ করল। বড় মেয়ে অর্থাৎ ক্ষেন্তির হাতে পাতা জড়ানো কিছু একটা ; ছোট মেয়ে অর্থাৎ রাধীর হাতে অনেকটা পুঁই শাক। ]
সহায়হরি : ( মেয়েদের হাতের পুঁই শাক ও পাতার মোড়ক লক্ষ্য করে ) - এ সব কি রে ? ক্ষেন্তি মা , এসব কোথা থেকে আনলি ?
ক্ষেন্তি ( পাতার মোড়কটি খুলে মেলে ধরে ) : চিংড়ি মাছ , বাবা। গয়া বুড়ির কাছ থেকে রাস্তায় নিলাম , দিতে চায় না , বলে - তোমার বাবার কাছে আর - দিনের দু'টো পয়সা বাকি আছে। আমি বললাম - দাও গয়া পিসি , আমার বাবা কি তোমার দু'টো পয়সা নিয়ে পালিয়ে যাবে ! ............... আর এই পুঁই শাকগুলো ঘাটের ধারে রায় কাকা দিয়ে বললে , নিয়ে যা ...........
অন্নপূর্ণা ( ঝাঁঝের সঙ্গে ) : উমম .... নিয়ে যা ......... আহা কি অমর্তই তোমাকে তারা দিয়েছে ! পাকা পুঁই ডাঁটা কাঠ হয়ে গিয়েছে , দু'দিন পরে ফেলে দিত ......... নিয়ে যা ......... আর উনি আগাছা উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন .......... ভালোই হয়েছে , তাদের আর নিজেদের কষ্ট করে কাটতে হলো না ........... যত পাথুরে বোকা সব এসে জুটে আমার ঘাড়ে। ........
সহায়হরি : আহা এমন করে বলার কী আছে ? ও কি আর অত জেনে বুঝে ........ বাচ্চা মেয়ে ........
অন্নপূর্ণা : তুমি থামো ........ বাচ্চা মেয়ে ......... বিয়ে হলে যে চার ছেলের মা হত ! খাওয়ার নামে আর জ্ঞান থাকেনা। একজন সারাদিন ধরে কোথায় শাক , কোথায় বেগুন করে বেড়াচ্ছেন এবং আরেকজন কোথায় রস , কোথায় ছাই , কোথায় পাঁশ করে বেড়াচ্ছেন। ( মেয়েদের উদ্দেশ্যে ) ফেল , ফেল বলছি ওসব ...... ফেল।
[ ভয়ে মেয়েদের হাত থেকে পুঁই শাক পড়ে গেল। ]
অন্নপূর্ণা : যা তো রাধী , ও আপদগুলো টেনে খিড়কীর পুকুরের ধারে ফেলে দিয়ে আয় তো ........... ফের যদি বাড়ির বার হতে দেখেছি , তবে ঠ্যাং খোঁড়া না করি তো ............. ।
[ রাধী পড়ে যাওয়া পুঁই শাকগুলিকে গুছিয়ে নিয়ে প্রস্থান করতে উদ্যত। ]
সহায়হরি ( আমতা আমতা করে ) : তা থাক না , এনেছে ছেলেমানুষ খাবে বলে ........ তুমি আবার ........
[ রাধী আশা নিয়ে থমকে দাঁড়াল। একবার বাবার দিকে , একবার মায়ের দিকে তাকাল। ]
অন্নপূর্ণা ( ঠান্ডা মেজাজে ) : না ,না , নিয়ে যা , খেতে হবে না ........ মেয়ে মানুষের আবার অত নোলা কিসের ! যা , যা ফেলে দিয়ে আয়।
[ রাধী বাবার দিকে তাকাল। বাবা মাথা নীচু করে নিলেন। আর কোনো আশার কারণ নেই দেখে রাধী ধীরে ধীরে মঞ্চ থেকে প্রস্থান করল। আলো ধীরে ধীরে কমে এল। ]
দ্বিতীয় দৃশ্য :-
মঞ্চসজ্জা : প্রথম দৃশ্যে উপস্থিত সকল প্রকার আসবাবগুলিকে সরিয়ে ফেলতে হবে। এই দৃশ্যে মঞ্চ সম্পূর্ণ ফাঁকা থাকবে। তবে , বেশ কয়েকজনের বসার জন্য বেঞ্চ , তক্তপোশ বা খাটিয়া - এই ধরণের কিছু উপকরণ রাখতে পারলে ভাল হয়।
[ বেশ কয়েকজন গ্রামবাসী সহ কালীময় মঞ্চে উপবিষ্ট। তাঁরা নিজেদের মধ্যে কিছু কথাবার্তা বলছেন। ধীরে ধীরে মঞ্চে সহায়হরির প্রবেশ। সকলের লক্ষ্য তাঁর দিকে। ]
কালীময় : আরে , আরে , .......... সহায়হরি যে ........... এস এস ভায়া , এদিকে এস। তা আছ কেমন ?
সহায়হরি ( আমতা আমতা করে ) : এই আছি একরকম ......... ঈশ্বর যেমন রেখেছেন।
কালীময় : আর আমাদের ভাল থাকা ! সেই সব ভাল থাকার দিন কি আর আছে ভায়া ! এই ......... এই যেমন ধর , কেষ্ট মুখুয্যে ........... স্বভাব নইলে পাত্র দেব না করে কী কান্ডটাই করলে .......... অবশেষে কিনা হরির ছেলেটাকে ধরে পড়ে মেয়ের বিয়ে দেয় , তবে রক্ষে ! তার কী স্বভাব ? রাম বলো , ছ'সাত পুরুষে ভঙ্গ , পচা শ্রোত্রিয় !
[ একটু সুর নরম করে ]
তা সমাজের সে - সব শাসনের দিন কি আর আছে ? দিন দিন চলে যাচ্ছে। বেশি দূর যাই কেন , এই ...... এই যে তোমার মেয়েটি তেরো বছরের ............
সহায়হরি ( কালীময়কে বাধা দিয়ে ) : এই শ্রাবনে তেরোয় ..........
কালীময় ( সহায়হরিকে থামিয়ে দিয়ে ) : আহা - হা , তেরোয় আর ষোলোয় তফাৎ কীসের শুনি ? আর সে তেরোই হোক , চাই ষোলোই হোক , চাই পঞ্চাশই হোক , তাতে আমাদের দরকার নেই , সে তোমার হিসেবে তোমার কাছে। কিন্তু পাত্তর আশীর্বাদ হয়ে গেল , তুমি বেঁকে বসলে কী জন্য শুনি ? ও তো এরকম উৎসর্গ করা মেয়ে। আশীর্বাদ হওয়াও যা বিয়ে হওয়াও তা , সাত পাকের যা বাকি , এই তো ? ........ সমাজে বসে এসব কাজগুলো তুমি যে করবে আর আমরা বসে বসে দেখব - এ তুমি মনে ভেবো না। সমাজের বামুনদের যদি জাত মারবার ইচ্ছে না থাকে , মেয়ের বিয়ের বন্দোবস্ত করে ফেল।
[একটু থেমে , রাগে গজগজ করতে করতে ]
পাত্তর - পাত্তর ......... রাজপুত্তর না হলে পাত্তর মেলে না ? গরীব মানুষ , দিতে - থুতে পারবে না বলেই শ্রীমন্ত মজুমদারের ছেলেকে ঠিক করে দিলাম। লেখাপড়া নাই বা জানলো , জজ মেজেস্টার না হলে কি মানুষ হয় না ? দিব্যি বাড়ী বাগান পুকুর , শুনলাম এবার নাকি কুঁড়ির জমিতে চাট্টি আমন ধানও করেছে , ব্যাস - রাজার হাল ! দুই ভায়ের অভাব কী ?
সহায়হরি ( আমতা আমতা করে , কিন্তু দৃঢ়ভাবে ) : না কালীময় , অমন দুশ্চরিত্র পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া সঙ্গত নয়।
কালীময় : দুশ্চরিত্র ! কীভাবে জানলে তুমি যে পাত্র দুশ্চরিত্র ?
সহায়হরি : কে না জানে ! তোমার শ্রীমন্ত মজুমদারের ছেলে ওই কুম্ভকার বধূর আত্মীয়দের কাছে বেদম প্রহার খেয়েছিল কেন - তা বলতে পার ?
কালীময় ( থমকে গেলেন ; কিন্তু প্রসঙ্গ পাল্টে অত্যন্ত মেজাজের সঙ্গে ) : আমরা অতশত বুঝিনে বাপু , তুমি তোমার বড় মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা কর - এই হল আমাদের সকলের কথা।
[ মঞ্চ থেকে প্রস্থান করতে করতে ]
এই গ্রামে থেকে এমন অনাচার আমরা সইবো না , এত বড় ধিঙ্গি মেয়ে ...... তার বিয়ে না দিয়ে বাড়িতে বসিয়ে রাখে ......... কেমন বাপ্ রে বাবা !
[ কালীময় প্রস্থান করলেন। অন্যান্য সকলে সহায়হরিকে ঘিরে গুঞ্জন শুরু করল। সহায়হরি মাথা নীচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। ]
তৃতীয় দৃশ্য :-
মঞ্চসজ্জা : প্রথম দৃশ্যের অনুরূপ।
[ সহায়হরি মঞ্চের সম্মুখে উপবিষ্ট। একমনে কিছু একটা করতে ব্যাস্ত। ক্ষেন্তি চুপি চুপি মঞ্চে প্রবেশ করে। সহায়হরির দিকে এগিয়ে যায়। খুব সচেতন হয়ে চারিদিক দেখে নেয় একবার। ]
ক্ষেন্তি : বাবা , যাবে বরোজপোতার জঙ্গলে ? মা ঘাটে গেল .............. ।
সহায়হরি ( সন্তর্পনে চারদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে ; নিম্নস্বরে ) : যা শিগগির , শাবলখানা নিয়ে আয় দিকি !
[ সহায়হরি আরেকবার সন্তর্পনে চারদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়। ইতিমধ্যে ক্ষেন্তি দৌড়ে গিয়ে চৌকির তলা থেকে একটি শাবল বের করে এনে সহায়হরির হাতে দেয়। সহায়হরি ক্ষেন্তিকে ইশারা করে। দুজনে মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যায়। মঞ্চ অন্ধকার হয়ে আসে। দু - এক মুহূর্ত পর আবার আলো জ্বলে ওঠে। এবার মঞ্চে অন্নপূর্ণা উপস্থিত। একটি বালতির মধ্যে কিছু কাপড়। অন্নপূর্ণা সেই বালতি থেকে কাপড় গুলিকে একটি একটি করে তোলে এবং একটি দড়ির উপর মেলতে থাকে। ]
অন্নপূর্ণা (রাগে গজগজ করতে করতে ) : এই সকাল সকাল বাপ - মেয়েতে কোথায় যে গেল ! কোনো কান্ডজ্ঞান নেই। যেমন বাবা তার তেমন মেয়ে।
[ অন্নপূর্ণার এইসব কথার মাঝেই সহায়হরি ও ক্ষেন্তি দ্রুতপায়ে মঞ্চে প্রবেশ করে। হাতে একটি বড় আকারের মেটে - আলু। কিন্তু মঞ্চে প্রবেশ করেই তারা থতমত খেয়ে যায় অন্নপূর্ণাকে দেখে। অন্নপূর্ণা অগ্নিমূর্তিতে সহায়হরি ও ক্ষেন্তির দিকে তাকিয়ে। ]
অন্নপূর্ণা ( অত্যন্ত কড়া গলায় ) : এই সকাল সকাল বাবা মেয়েতে কোন ষড়যন্ত্র করছ শুনি ? ক্ষেন্তি ....... হাতে ওটা কী ?
সহায়হরি ( ক্ষেন্তিকে আড়াল করে ) : ও , ওটা ! ........ ওটা তো মেটে আলু। ...... ওই ও পাড়ার ময়শা চৌকিদার রোজই বলে - কর্তা ঠাকুর , তোমার বাপ থাকতে তবু মাসে মাসে এদিকে তোমাদের পায়ের ধুলো পড়ত , তা আজকাল তো তোমরা আর আস না , এই বেড়ার গায়ে মেটে আলু করে রেখেছি , তা দাদাঠাকুর বরং .............
অন্নপূর্ণা ( সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে ) : বটে , চৌকিদার দিয়েছে ? চৌকিদার কি তোমাদের শাবল নিয়ে যেতে বলেছিল ? [ ক্ষেন্তি খুব ভয় পেয়ে হাতের শাবলটি আড়াল করার চেষ্টা করে ] কী রে ক্ষেন্তি , কোথায় গিয়েছিলি - সত্যি করে বলতো ? ওই বরোজপোতার জঙ্গলে ?
সহায়হরি ( অন্নপূর্ণার কথাতে যেন আকাশ থেকে পড়ল ) : বরোজপোতার জঙ্গলে ? কক্ষনো না। বললাম তো চৌকিদার ..........
অন্নপূর্ণা ( সহায়হরিকে থামিয়ে দিয়ে ) : থাক , তিন কাল গিয়েছে এক কাল আছে , মিথ্যা কথাগুলো আর এখন বোলো না। আমি সব জানি। মনে ভেবেছিলে আপদ ঘাটে গিয়েছে আর কি .......... তা তুমি বরোজপোতার জঙ্গলে মেটে আলু চুরি করতে গিয়েছিলে - যাও ; কিন্তু মেয়েটাকে আবার এর মধ্যে নিয়ে গিয়ে ওর মাথা খাওয়া কিসের জন্য ?
[একটু থেমে ]
ক্ষেন্তি এদিকে আয়।
[ক্ষেন্তি অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে অন্নপূর্ণার দিকে এগিয়ে যায় ]
এই মেটে আলুটা দুজনে মিলে তুলে এনেছিস না ?
[ ক্ষেন্তি চুপ করে থাকে ]
কথা বলছিস নে যে বড় ? এই মেটে আলু তুই তুলে এনেছিস কি না ?
ক্ষেন্তি ( মৃদুস্বরে ) : হ্যাঁ।
অন্নপূর্ণা ( তেলে - বেগুনে জ্বলে উঠে ) : পাজী , আজ তোমার পিঠে আমি আস্ত কাঠের চেলা ভাঙব তবে ছাড়ব। বরোজপোতার বনে গিয়েছে মেটে আলু চুরি করতে ! সোমত্ত মেয়ে , বিয়ের যুগ্যি হয়ে গেছে কোন কালে , ........... সেই একগলা বিজন বন , যার মধ্যে দিনদুপুরে বাঘ লুকিয়ে থাকে , তা মধ্যে থেকে পরের আলু নিয়ে এল তুলে ? যদি গোঁসাইরা চৌকিদার ডেকে তোমায় ধরিয়ে দেয় ? তোমার কোন শ্বশুর এসে তোমায় বাঁচাত ? আমার জোটে খাব , না জোটে না খাব , তা বলে পরের জিনিসে হাত ? এ মেয়ে আমি কী করব মা ? .......... [ কপাল চাপড়াতে থাকে ]
চতুর্থ দৃশ্য :-
মঞ্চসজ্জা : প্রথম দৃশ্যের অনুরূপ।
[ মঞ্চে অন্নপূর্ণা , ক্ষেন্তি , পুঁটি ও রাধী উপস্থিত। ক্ষেন্তি নারকেল কুড়ছে। অন্নপূর্ণা একটি মাটির হাঁড়িতে পিঠে তৈরী করছেন ও ময়দার গোলা মাখছেন। ]
পুঁটি ( ডানহাত সামনের দিকে এগিয়ে দিয়ে ) : মা আমায় একটু ক্ষীর দেবে ?
রাধী ( সে'ও পুঁটির দেখাদেখি তার হাত মায়ের দিকে বাড়িয়ে দেয় ) : মা , আমাকেও একটু !
[ অন্নপূর্ণা দুজনকেই ছোট ছোট বাটিতে করে ক্ষীর দিলেন। ]
অন্নপূর্ণা : ক্ষেন্তি মা , তোকে একটু দিই !
[ ক্ষেন্তির সম্মতির অপেক্ষা না করেই অন্নপূর্ণা ক্ষেন্তিকেও একটি বাটিতে করে ক্ষীর দিলেন। ]
পুঁটি : জেঠাইমারা অনেকখানি দুধ নিয়েছে , রাঙাদিদি ক্ষীর তৈরী করছিল , ওদের অনেক রকম হবে।
ক্ষেন্তি : হ্যাঁ , ও-বেলা ওদের তো পায়েস , ঝোল - পুলি , মুগতক্তি - এইসব হয়েছে। ওরা তো নেমন্তন্নও করেছিল সুরেশ কাকাকে আর ও - পাড়ার তিনুর বাবাকে।
অন্নপূর্ণা ( খুন্তি দিয়ে হাঁড়ির ভেতর জোরে নাড়াতে নাড়াতে ) : ওরে , তোরা সব এক এক টুকরো পাতা পেতে বোস তো দেখি , গরম গরম দিই।
[ ঠিক এই সময় সহায়হরি মঞ্চে প্রবেশ করলেন। মন উৎফুল্ল। ]
সহায়হরি : এই শুনছো ক্ষেন্তির মা , খুব ভাল একটা খবর নিয়ে এসেছি।
অন্নপূর্ণা ( মেয়েদেরকে পিঠে পরিবেশন করতে করতে ) : তা কী এমন ভাল খবর শুনি ?
সহায়হরি ( উচ্ছাসের সঙ্গে ) : ক্ষেন্তির বিয়ে ঠিক করে এলাম গো ..........
অন্নপূর্ণা (অবাক হয়ে ) : বলো কী ! বিয়ে ! সত্যি ! ( আনন্দিত )
সহায়হরি : তাহলে আর বলছি কি ! শোনো , শহরে আমাদের যে দূর সম্পর্কের আত্মীয় আছে না , তার ঘটকালিতেই বিয়ে ঠিক করে ফেললাম।
অন্নপূর্ণা : তা ..... পাত্রের পরিচয় ?
সহায়হরি : পাত্রের বয়স চল্লিশের বেশি নয়। তবে .........
অন্নপূর্ণা : তবে ?
সহায়হরি : পাত্রের এটি দ্বিতীয় পক্ষ।
অন্নপূর্ণা : না , না , দ্বিতীয় পক্ষের পাত্রে মেয়ে দেওয়ার ইচ্ছে আমার নেই।
সহায়হরি : আরে , অমত কোরো না। পাত্রটি বেশ সঙ্গতিসম্পন্ন। শহর অঞ্চলে বাড়ি , চুন ও ইটের ব্যবসায়ে বেশ পয়সা করেছে। এমন পাত্র হঠাৎ করে পেতে কপালের জোর লাগে।
অন্নপূর্ণা : দেখো , যা ভালো বোঝো করো।
পঞ্চম দৃশ্য :-
মঞ্চসজ্জা : মঞ্চ সম্পূর্ণ ফাঁকা থাকবে। অথবা , নাট্যপরিচালক নিজ ইচ্ছানুযায়ী বিবাহের আবহ তৈরী করতে পারেন।
[ মঞ্চে সহায়হরি এবং তাঁর পরিবারের সকলে , ক্ষেন্তির সঙ্গে সদ্য বিবাহিত পাত্র - উভয়ই বিবাহের সাজে। সেইসঙ্গে ঠানদিদি উপস্থিত। সকলের মধ্যে খুশি ও ক্ষেন্তির বিদায়ের কষ্ট মিশ্রিত এক ভাব। ]
সহায়হরি : যাক , বিয়ে সুসম্পন্ন হল। এবার তোমরা দুজনে ভালো থেকো ; দুজনে দুজনের পাশে থেকো।
অন্নপূর্ণা ( ক্ষেন্তিকে আলিঙ্গন করে ) : ভালো থাকিস মা , এই গরীব মা'কে ভুলে যাসনে কিন্তু ! ওখানে একটু গোছানো হয়ে গেলে আসিস একবার।
ক্ষেন্তি ( আলিঙ্গন মুক্ত করে ) : মা , আষাঢ় মাসেই আমাকে এনো ...... বাবাকে পাঠিয়ে দিও .......... দু'টো মাস তো ........
ঠানদিদি ( রসিকতা করে ) : তোর বাবা বাড়ী কেন যাবে রে , আগে নাতি হোক - তবে তো ..........
ক্ষেন্তি ( লজ্জায় রাঙা হয়ে ) : থামো তো তুমি ...........
সহায়হরি ( জামাইয়ের হাত ধরে ) : একটু মানিয়ে গুছিয়ে নিও বাবা ; যেটুকু পেরেছি - শিক্ষে দিয়েছি। কোনো অসুবিধে হলে বোলো।
জামাই ( সহায়হরির হাত ধরে আস্বাসের সঙ্গে ) : আপনি কোনো চিন্তা করবেন না বাবা , ও'কে আমি ভালো রাখবো।
[ জামাই ও ক্ষেন্তি অন্নপূর্ণা ও সহায়হরিকে প্রণাম করে ]
জামাই : আসি তবে মা ..........
[ ক্ষেন্তি ও জামাই ধীরে ধীরে মঞ্চ পরিত্যাগ করে। ক্ষেন্তি বারবার মুখ ঘুরিয়ে পেছনে ফিরে দেখতে থাকে। অন্নপূর্ণা ও সহায়হরিও সেই দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো ধীরে ধীরে কমে আসে। ]
ষষ্ঠ দৃশ্য :-
মঞ্চসজ্জা : প্রথম দৃশ্যের অনুরূপ।
[ ক্ষেন্তি বাদে সহায়হরির পুরো পরিবার মঞ্চে উপস্থিত। সহায়হরি উদাস মনে তামাক সেবন করছেন। মঞ্চে বিষ্ণু সরকারের প্রবেশ। ]
বিষ্ণু সরকার : সহায়হরি , ও সহায়হরি ....... বাড়িতে আছ না'কি হে ?
সহায়হরি ( নিরুত্তাপ কণ্ঠে ) : ও বিষ্ণু , এস , বস।
[ বিষ্ণু সরকার খাটিয়ার একপাশে বসে পড়ে। ]
বিষ্ণু : তোমার মেয়েটির হয়েছিল কী ?
সহায়হরি : বসন্ত হয়েছিল শুনলাম। [ একটু থেমে ] ব্যাপার কি দাঁড়াল , বুঝলে ? মেয়ে তো কিছুতে পাঠাতে চায় না। আড়াইশো টাকা আন্দাজ বাকি ছিল , বললে , ও টাকা আগে দাও , তবে মেয়ে নিয়ে যাও।
বিষ্ণু : এ - তো একেবারে চামার ........
সহায়হরি : তারপর বললাম , টাকাটা ক্রমে ক্রমে দিচ্ছি। শুনেই ওরা মেয়ের নানারকম নিন্দে শুরু করল। পৌষ মাসেও দেখতে গেলাম , মেয়েটাকে ফেলে থাকতে পারতাম না বুঝলে ........
[ কিছুক্ষন দুজনেই চুপ ]
বিষ্ণু : তারপর ?
সহায়হরি : আমার স্ত্রী অত্যন্ত কান্নাকাটি করাতে সেই পৌষ মাসে গেলাম। কি আর বলবো , মেয়েটার যা অবস্থা করেছে ওরা ! তার উপর আবার শাশুড়ি শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে শুরু করল যে তারা ছোটলোকের সঙ্গে কুটুম্বিতা করেছে।
[বিষ্ণুর দিকে তাকিয়ে ]
বলি আমরা ছোটোলোক কি বড়লোক তোমার তো সরকার খুড়ো জানতে বাকি নেই। বলি , পরমেশ্বর চাটুয্যের নামে নীলকুচির আমলে এ অঞ্চলে বাঘে গরুতে একঘাটে জল খেয়েছে - সে কথা ওদের আর কী বলব !
[ বিষ্ণু সরকার সমর্থনসূচক ঘাড় নাড়লেন ]
সহায়হরি : তারপর ফাল্গুন মাসেই তার বসন্ত হল। এমন চামার , বসন্ত গায়ে বেরুতেই টালায় আমার দূর সম্পর্কের বোনের কাছে ওকে পাঠিয়ে দিলে। আমায় একটা সংবাদ পর্যন্ত দিলে না।
বিষ্ণু : দেখতে পাওনি ?
সহায়হরি : নাঃ ! এমনি চামার - গহনাগুলো অসুখ অবস্থাতেই গা থেকে খুলে নিয়েছিল।
[ একটু থেমে ] থাক , বাদ দাও এসব কথা , মাছ ধরতে যেতে হবে , দেরি হয়ে গেল ; চার এনেছো তো ?
বিষ্ণু : হ্যাঁ।
সহায়হরি : তা তুমি এগোও , আমি একটু পরে আসছি।
[ বিষ্ণু সরকার মঞ্চ থেকে প্রস্থান করলেন। এর কিছুক্ষন পর অন্নপূর্ণা সহায়হরির দিকে এগিয়ে গেলেন। ]
অন্নপূর্ণা : এবার কী শীত পড়েছে না ! আমার জ্ঞানে তো এরকম শীত আমি কখনো দেখিনি।
[একটু থেমে ] একটা জিনিস দেখবে ?
সহায়হরি : কী ?
অন্নপূর্ণা : আরে , এদিকে এসই না।
[ অন্নপূর্ণা মঞ্চের একেবারে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। সহায়হরি ধীরে ধীরে অন্নপূর্ণার পাশে এসে দাঁড়ালেন। দুজনের দৃষ্টিই দর্শকদের দিকে। যেন অদৃশ্য কোনো কিছুকে তারা দুজনেই দেখছে। ]
অন্নপূর্ণা : ওই দেখো , পুঁই মাচা। ক্ষেন্তি কত যত্ন করে , আমার সঙ্গে ঝগড়া করে পুঁইয়ের চারাটি লাগিয়েছিল। আজ সেই পুঁইগাছটিকে দেখ , গোটা মাচায় ছড়িয়ে পড়েছে। সুপুষ্ট , নধর। প্রবর্ধমান জীবনের লাবণ্যে ভরপুর। ঠিক যেন ......... ঠিক যেন ..........
সহায়হরি : ক্ষেন্তির মত।
[ দুজনেই স্থির হয়ে একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। পর্দা ধীরে ধীরে নেমে এল। ]