hs bengali project : byomkesh bakshi

by - November 22, 2021

HS BENGALI PROJECT :- 

উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রকল্প :-  

চরিত্র পর্যালোচনা : ব্যোমকেশ বক্সী। 




ভূমিকা : - 

বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট হল মহান সাহিত্যিকদের সৃষ্ট বিভিন্ন চরিত্রগুলিকে কেন্দ্র করে সাহিত্য ক্ষেত্রে এক - একটি বিশেষ জগৎ তৈরী করেছে। এই সকল সাহিত্য চরিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম হল - ফেলুদা , ঘনাদা , টেনিদা , ব্যোমকেশ বক্সী , কিকিরা , কাকাবাবু - প্রমুখ। প্রতিটি চরিত্রের ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট বর্তমান। এই ধরণের চরিত্র কেন্দ্রিক সাহিত্য বাংলা সাহিত্য জগৎকে আরো প্রসারিত করেছে এবং চরিত্রগুলি পাঠককুলের মনে চিরস্থায়ী স্থান দখল করে রেখেছে ও বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। এই চরিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম হল শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের রচিত ও সৃষ্ট ব্যোমকেশ বক্সী চরিত্রটি। 

বর্তমান প্রকল্পটিতে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ও সৃষ্ট ব্যোমকেশ বক্সী চরিত্রটির পর্যালোচনা করা হয়েছে। ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন গল্প ও উপন্যাস , চারিত্রিক বৈশিষ্ট , গল্পগুলির রচনাশৈলী , ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে তৈরী বিভিন্ন চলচ্চিত্র ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি বর্তমান প্রজন্মের পাঠককুলের কাছে ব্যোমকেশ বক্সী কতটা গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় সে বিষয়েও তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। 


যে সকল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এই প্রতিবেদনমূলক প্রকল্পটি রূপায়ণ করা হয়েছে , সেগুলি হল - 
১. বাংলা সাহিত্যে চরিত্রনির্ভর সাহিত্যকীর্তিগুলি সম্পর্কে জ্ঞানলাভ। 
২. শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ব্যোমকেশ বক্সী চরিত্রটি সম্পর্কে আলোকপাত করা। 
৩. চরিত্রটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট সম্পর্কে আলোচনা করা। 
৪. শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখনীশৈলী সম্পর্কে আলোচনা করা। 
৫. ব্যোমকেশ বক্সী চরিত্রটি নিয়ে যে সকল গঠনমূলক শিল্পকীর্তি রচিত হয়েছে সেগুলির তথ্য তুলে ধরা। ৬. বর্তমান প্রজন্মের পাঠককুলের মধ্যে ব্যোমকেশ বক্সী কতটা জনপ্রিয় - সে বিষয়ে পর্যালোচনা করা। ৭. বর্তমান সাহিত্য জগতে ব্যোমকেশ বক্সীর প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা। 
৮. সর্বপরি , বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি ব্যোমকেশ বক্সী চরিত্রটি সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের কৌতুহলী করে তোলা। 

প্রকল্পটির গুরুত্ব : - 

যে সকল কারণে প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতে পারে , সেগুলি হল -    

১. প্রকল্পটির মাধ্যমে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি ব্যোমকেশ বক্সী চরিত্রটি সম্পর্কে জানা সম্ভব। ২. ব্যোমকেশ বক্সীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট , লেখকের রচনাশৈলী - এই বিষয়গুলি সম্পর্কে প্রকল্পটিতে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। 
৩. ব্যোমকেশ বক্সী চরিত্রটি বাংলা সাহিত্যকে কতটা প্রভাবিত করেছে  - সে সম্পর্কে জানতে প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ। 
৪. বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থী ও পাঠকবৃন্দের মধ্যে ব্যোমকেশ বক্সী কতটা জনপ্রিয় ও চরিত্রটি তাদের সাহিত্য ও সৃজনশীল মননকে কতটা প্রভাবিত করেছে - সে সম্পর্কে জানতে প্রকল্পটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। 
৫. লেখক শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায় ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে যেসকল গল্প লিখেছেন , ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে যেসকল চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে - সে সকল তথ্য প্রকল্পটিতে সহজেই পাওয়া সম্ভব। 
৬. সর্বপরি , ব্যোমকেশ বক্সীর মত একটি কালজয়ী চরিত্র সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের কৌতুহলী করে তুলতে প্রকল্পটি কার্যকরী। 



প্রকল্পের বিষয় নির্বাচিত করার পর বিদ্যালয়ের বাংলা বিষয়ের প্রকল্প তত্ত্বাবধায়ক / তত্ত্বাবধায়িকা নির্দেশ অনুসারে বিভিন্ন গ্রন্থপাঠ করে প্রকল্পের প্রতিবেদন রচনার জন্য বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠ করা হয়। এই ক্ষেত্রে ব্যোমকেশ বক্সীর গল্পগুলি পাঠ করা হয় চরিত্রটির সম্পর্কে সাধারণ ধারণা পাওয়ার জন্য। এরপর পাঠ করা গল্পগুলির ভিত্তিতে ও ইন্টারনেট থেকে আরো কিছু তথ্য সংগ্রহ করে একটি প্রকল্প রচনা করে প্রকল্প তত্ত্বাবধায়ক / তত্ত্বাবধায়িকার নিকট উপস্থাপন করা হয় ও পরে তার নির্দেশমত প্রয়োজনীয় সংশোধনের পর প্রকল্পটি সম্পূর্ণ হয়। 

তথ্য বিশ্লেষণ : - 

সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে প্রকল্পের বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল। 

ব্যোমকেশ বক্সী শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সৃষ্ট বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র।

চরিত্রটির পরিচয় :-     
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্ট চরিত্র হিসেবে ব্যোমকেশ বক্সীর আবির্ভাব হয় সত্যান্বেষী গল্পে। ১৩৩১ বঙ্গাব্দে কলকাতার চীনাবাজার অঞ্চলে পরপর কয়েকটি খুনের ঘটনার কিনারা করতে 'বে-সরকারী ডিটেকটিভ' ব্যোমকেশ বক্সী পুলিশ কমিশনারের অনুমতি নিয়ে অতুলচন্দ্র মিত্র ছদ্মনামে এই অঞ্চলে এক মেসে বসবাস শুরু করেছিলেন। এই মেসে তার ঘরের অন্য ভাড়াটিয়া অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যোমকেশের অধিকাংশ গোয়েন্দা গল্পগুলি লিখিয়েছিলেন। সত্যান্বেষী গল্পে ব্যোমকেশের বিবরণ দিতে গিয়ে অজিত বলেছেন, ...তাহার বয়স বোধকরি তেইশ-চব্বিশ হইবে, দেখিলে শিক্ষিত ভদ্রলোক বলিয়া মনে হয়। গায়ের রঙ ফরসা, বেশ সুশ্রী সুগঠিত চেহারা-মুখে চোখে বুদ্ধির একটা ছাপ আছে। এই গল্পের শেষে জানা যায়, হ্যারিসন রোডের একটি বাড়ীর তিনতলা ভাড়া নিয়ে ব্যোমকেশ বসবাস করেন। এই বাড়িতে ব্যোমকেশ ছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তি তার পরিচারক পুঁটিরাম। ব্যোমকেশের অনুরোধে অজিত এই বাড়ীতে বসবাস শুরু করেন। বাড়ীর দরজায় পেতলের ফলকে লেখা ছিল শ্রীব্যোমকেশ বক্সী, সত্যান্বেষী। সত্যান্বেষীর অর্থ জিজ্ঞাসা করায় অজিতকে ব্যোমকেশ বলেন, ওটা আমার পরিচয়। ডিটেকটিভ কথা শুনতে ভালো নয়, গোয়েন্দা শব্দটা আরও খারাপ, তাই নিজের খেতাব দিয়েছি সত্যান্বেষী। পরের গল্পগুলিতে ব্যোমকেশ নিজেকে সত্যান্বেষী বলেই পরিচয় দিয়েছেন। অর্থম - অনর্থম্‌ গল্পে ব্যোমকেশের সঙ্গে একটি খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত সুকুমারবাবুর বোন সত্যবতীর পরিচয় হয় , যার সাথে পরে তার বিবাহ সম্পন্ন হয়। আদিম রিপু গল্পে ব্যোমকেশের বাল্যকাল সম্বন্ধে কিছু তথ্য জানা যায়। ব্যোমকেশের পিতা স্কুলে অঙ্কের শিক্ষক ছিলেন ও বাড়িতে সাংখ্য দর্শনের চর্চা করতেন এবং তার মাতা বৈষ্ণব বংশের মেয়ে ছিলেন। ব্যোমকেশের যখন সতেরো বছর বয়স, তখন তার পিতা ও পরে তার মাতা যক্ষ্মা রোগে মারা যান। পরে ব্যোমকেশ জলপানির সাহায্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ভারতের স্বাধীনতা লাভের পরেও অজিত ও সপরিবারে ব্যোমকেশ হ্যারিসন রোডের বাড়িতে বসবাস করেন। পরে তারা দক্ষিণ কলকাতার কেয়াতলায় জমি কিনে সেখানে বাড়ি বানিয়ে চলে যাবেন বলে মনস্থির করেন। 

গল্পলেখক অজিত - এর পরিচয় :- 
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যোমকেশ বক্সী সিরিজের গল্পগুলিতে লেখক হিসেবে ব্যোমকেশের বন্ধু অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়কে উপস্থাপিত করেছেন। ব্যোমকেশের প্রতিটি রহস্যভেদের সঙ্গী অজিতের লেখনীতে ব্যোমকেশের অধিকাংশ গল্পগুলি তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু রুম নম্বর দুই, শজারুর কাঁটা, বেণীসংহার, লোহার বিস্কুট, বিশুপাল বধ এই গল্পগুলিতে অজিতকে গল্পলেখক হিসেবে উপস্থিত করা হয়নি। এই প্রসঙ্গে শরদিন্দু বলেছেন, অজিতকে দিয়ে ব্যোমকেশের গল্প লেখানো আর চলছে না। একে তো ভাষা সেকেলে হয়ে গেছে, এখনো চলতি ভাষা আয়ত্ত করতে পারেনি, এই আধুনিক যুগেও 'করিতেছি', 'খাইতেছি' লেখে। উপরন্তু তাঁর সময়ও নেই। পুস্তক প্রকাশের কাজে যে লেখকেরা মাথা গলিয়েছেন তাঁরা জানেন, একবার মা-লক্ষ্মীর প্রসাদ পেলে মা-সরস্বতীর দিকে আর নজর থাকে না। তাছাড়া সম্প্রতি অজিত আর ব্যোমকেশ মিলে দক্ষিণ কলকাতায় জমি কিনেছে, নতুন বাড়ি তৈরী হচ্ছে; শীগ্‌গিরই তারা পুরনো বাসা ছেড়ে কেয়াতলায় চলে যাবে। অজিত একদিকে বইয়ের দোকান চালাচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ি তদারক করছে; গল্প লেখার সময় কোথায়? ...... দেখেশুনে অজিতকে নিস্কৃতি দিলাম, এখন থেকে আমিই যা পারি লিখব। 

ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন গল্প ও উপন্যাস :- 
রচনাকাল অনুসারে ব্যোমকেশ সিরিজের প্রথম গল্প পথের কাঁটা (৭ই আষাঢ়, ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ) এবং দ্বিতীয় গল্প সীমন্ত-হীরা (৩রা অগ্রহায়ণ, ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ)। এই দুইটি গল্প লেখার পর শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যোমকেশ বক্সী চরিত্র নিয়ে সিরিজ লেখার কথা চিন্তা করে ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের ২৪শে মাঘ সত্যান্বেষী গল্প রচনা শেষ করে ব্যোমকেশ চরিত্রকে পাঠকের সামনে উপস্থিত করেন। সেই কারণে সত্যান্বেষী গল্পটিকে ব্যোমকেশ সিরিজের প্রথম গল্প হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। ১৩৩৯ থেকে ১৩৪৩ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত দশটি গল্প লেখার পর পাঠকদের ভালো লাগবে না ভেবে পনেরো বছর ব্যোমকেশকে নিয়ে আর কোন গল্প লেখেননি। এরপর কলকাতার পরিমল গোস্বামীর বাড়ির ছেলেমেয়েদের অনুরোধে ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের ৮ই পৌষ চিত্রচোর গল্পটি লেখেন। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যোমকেশ চরিত্র নিয়ে তেত্রিশটি কাহিনী রচনা করেছেন। এর মাঝে বিশুপাল বধ গল্পটি তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। পরবর্তীতে এই গল্প সম্পূর্ণ করেন সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যাল। 

ব্যোমকেশ বক্সী চরিত্র নিয়ে রচিত কাহিনীগুলি হল - সত্যান্বেষী , পথের কাঁটা , সীমন্ত-হীরা , মাকড়সার রস , অর্থমনর্থম্‌ , চোরাবালি , অগ্নিবাণ , উপসংহার , রক্তমুখী নীলা , ব্যোমকেশ ও বরদা , চিত্রচোর , দুর্গরহস্য , চিড়িয়াখানা , আদিম রিপু , বহ্নি-পতঙ্গ , রক্তের দাগ , মণিমণ্ডন , অমৃতের মৃত্যু , শৈলরহস্য , অচিন পাখি , কহেন কবি কালিদাস , অদৃশ্য ত্রিকোণ , খুঁজি খুঁজি নারি , অদ্বিতীয় , মগ্নমৈনাক , দুষ্টচক্র , হেঁয়ালির ছন্দ , রুম নম্বর দুই , ছলনার ছন্দ , শজারুর কাঁটা , বেণীসংহার , লোহার বিস্কুট , বিশুপাল বধ (অসমাপ্ত) , তিতির সেন হত্যা রহস্য। 

চলচ্চিত্রে ব্যোমকেশ বক্সী :- 
ব্যোমকেশ বক্সী চরিত্র নিয়ে রচিত গল্পগুলিকে ভিত্তি করে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এই চলচ্চিত্রগুলি তালিকাবদ্ধ করা হল-
১. চিড়িয়াখানা - সত্যজিৎ রায় -১৯৬৭
২. শজারুর কাঁটা - মঞ্জু দে - ১৯৭৪
৩. শজারুর কাঁটা - শ্যামল ঘোষাল , শৈলেন মুখোপাধ্যায়
৪. মগ্ন মৈনাক - স্বপন ঘোষাল -২০০৯
৫. ব্যোমকেশ বক্সী - অঞ্জন দত্ত -২০১০
৬. আদিম রিপু - আবীর চট্টোপাধ্যায় ,শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়
৭. আবার ব্যোমকেশ - অঞ্জন দত্ত -২০১২
৮. চিত্রচোর- আবীর চট্টোপাধ্যায় শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়
৯. সত্যান্বেষী-ঋতুপর্ণ ঘোষ-২০১৩ 
১০. চোরাবালি -সুজয় ঘোষ ,অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়
১১. দূরবীন - স্বাগত চৌধুরী - ২০১৪
১২. ব্যোমকেশ ফিরে এলো- অঞ্জন দত্ত-২০১৪
১৩. বেণী সংহার -আবীর চট্টোপাধ্যায় , শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়
১৪. ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী -হিন্দি দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৫। ইত্যাদি। 



সিদ্ধান্ত - গ্রহণ :- 

উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রক্ষিতে যে সকল সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় তা নিম্নরূপ :- 

১. বাংলা সাহিত্যে বেশ ক'জন গোয়েন্দার আবির্ভাব হলেও সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ফেলুদা এবং ব্যোমকেশ। কিন্তু গোয়েন্দা হলেও ব্যোমকেশ আর ফেলুদা এক কাতারের মানুষ নন। বইয়ের পাতায় ব্যোমকেশ যেন আমাদের চেনা একটি মুখ, যার সংসার আছে, সমাজে বিস্তর চলাফেরা আছে, নিজের উপার্জনের চিন্তা করতে হয়, এবং রক্ত-মানুষের মানুষের মতো সময়ের সাথে বয়স বৃদ্ধি হয়। আর তার কাছে আসা কেসগুলো অনেকটা সামাজিক সমস্যার, আমাদের সাংসারিক সমস্যার, একটি সমাজের বিবাদ ও ষড়যন্ত্রের। 

২. ব্যোমকেশের প্রত্যেকটি গল্পের অন্যতম সুন্দর দিক, যে সময়ে গল্পটি বলা হচ্ছে, সে সময়ের কলকাতার খুব দুর্দান্ত উপস্থাপন। পাঠক গল্পের সাথে, ব্যোমকেশের সমস্যা সমাধানের চিন্তাধারার পাশাপাশি তৎকালীন সময়ের কলকাতার চিত্র যেন নিজের চোখের সামনে কল্পনা করতে পারবেন। যেমন- 'আদিম রিপু'। এ গল্পের পটভূমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। বাংলায় এ বিশ্বযুদ্ধের তাণ্ডব বোঝা না গেলেও, সে সময়ে কলকাতার অবস্থা, মুসলমান বনাম হিন্দু দাঙ্গার প্রভাব পড়েছে গল্পেও। 

৩. এই বাংলায় ইংরেজ শাসনের সময়কাল ও সে সময়ের পরিস্থিতির উল্লেখ আছে। তাই অমৃতের মৃত্যু, খুঁজি খুঁজি নারী, রক্তের দাগ, সীমান্ত-হীরা এ সকল গল্প শুধু একজন গোয়েন্দার সত্য আবিষ্কারের কাহিনী নয়, এ গল্পগুলো সে সময়ে বাংলা ও কলকাতার অবস্থা ও পরিস্থিতিকে মনে করিয়ে দেয়। 

৪. গোয়েন্দা সাহিত্য ও প্রেম যে একই রেখায় চলতে পারে এমনটি দুর্লভ। কিন্তু শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তার চরিত্রকে প্রেমে আবদ্ধ করে রাখেননি। সত্যবতীর সাথে তাকে বিয়েও করিয়ে দেন। তাদের একটি সন্তানের কথাও কয়েকটি গল্পে উল্লেখ আছে। পরবর্তীতে প্রায় প্রত্যেকটি গল্পে সত্য অন্বেষণের পাশাপাশি তাদের সংসারের গল্প, তাদের খুনসুটি, মনোমালিন্য এবং দু'জনের ভালোবাসার নমুনা পাওয়া যায়। একজন গোয়েন্দা চরিত্রের এমন সাংসারিক কাব্য বাংলা সাহিত্যে এর আগে দেখা যায়নি।

৫. শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখনীতে ব্যোমকেশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রত্যেকটি সত্য আবিষ্কারের পরিশেষে যবনিকা পতন। 'অগ্নিবাণ' গল্পটি ছিলো এক ভয়ংকর রাসায়নিক নিয়ে। যে রাসায়নিক নিঃশ্বাসের সাথে দেহের ভেতরে ঢুকলে চোখের পলকে মৃত্যু ঘনিয়ে আসে। এমন মৃত্যুবাণ নিয়ে ব্যোমকেশ বলেছিল ভবিষ্যতের কথা। পৃথিবী হিংসায় যেমন জ্বলে-পুড়ে একে অন্যেকে ধ্বংস করার মাতাল খেলায় মেতেছে। এমন পদার্থ তৈরি করলে এ বিশ্ব কতদিন টিকবে!

৬.  'বহ্নি-পতঙ্গ' গল্পে দেখা মিলেছে কাব্যিক ব্যোমকেশের। এ গল্পের শেষে সত্যকে সামনে টেনে আনার সময় সে ভালোবাসা ও প্রেমের দুর্দান্ত এক সংজ্ঞা দিয়েছে, যা গোয়েন্দা চরিত্রের ভেতরে একটুকরো মানুষের প্রতিচ্ছবিকে তুলে ধরে। 

৭. শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সবসময় চেষ্টা করে গিয়েছেন ব্যোমকেশ বক্সী চরিত্রকে যতটা সম্ভব বাস্তবভাবে তুলে ধরার, যাতে পাঠকরা তাকে একজন সমাজে বসবাস করা সাধারণত মানুষ ও অন্যের সমস্যা সমাধানের পেশাকে আর দশটা পেশার মতো স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে। এজন্য ব্যোমকেশের স্বভাব, কর্মকাণ্ড, পরিচয় বা অবস্থা আর দশটি বাস্তব মানুষের মতো, কোনো বইয়ের পাতার চরিত্র নয়। তার কাছে আসা সমস্যাগুলোও আমাদের চারপাশের লোভ-লালসার, পারিবারিক কলহ, প্রেম ও ষড়যন্ত্রের মিশ্রণ। 

উপসংহার :- 

বাংলা সাহিত্যের এক অমর সৃষ্টি ব্যোমকেশ বক্সী। চরিত্রটি বাঙালির দৈনন্দিন জীবনের সাথে এমনভাবে মিশে গেছে যে , লেখকের মৃত্যুর এত বছর পরও ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলির জনপ্রিয়তা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। চরিত্রটির মধ্যে দিয়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা , ঘাত - প্রতিঘাত - ইত্যাদির প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও গল্পগুলির মধ্যে দিয়ে তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করা যায়। গল্পগুলির মধ্যে দিয়ে যেভাবে দৈনন্দিন জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে তাতে তৎকালীন সময়ের বাঙালিদের সাধারণ জীবনযাত্রা , সাজ পোশাক , খাদ্যাভ্যাস - ইত্যাদি সম্পর্কেও জানা যায়। বাংলা সাহিত্য জগতের এক বিশিষ্ট অংশ জুড়ে ব্যোমকেশ বক্সী চরিত্রটি এক গুরুত্বপূর্ণ অংশের অধিকারী এবং রাতের আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় বিরাজমান। 

গ্রন্থপঞ্জি / তথ্যসূত্র :- 

যে সকল গ্রন্থ ও ওয়েবসাইট প্রকল্পটি রচনার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে , সেগুলি হল - 

১. বাংলা ভাষা ও শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির ইতিহাস - দ্বাদশ শ্রেণি - পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ।

২. www. wikipedia.com 

৩. roarmedia.com        


You May Also Like

0 comments