H.S. Sociology project : The role of mass media in society . উচ্চমাধ্যমিক প্রকল্প : সমাজ জীবনে গণমাধ্যমের ভূমিকা।
H.S. Sociology project : The role of mass media in society .
উচ্চমাধ্যমিক প্রকল্প : সমাজ জীবনে গণমাধ্যমের ভূমিকা।
সূচনা / ভূমিকা :-
আক্ষরিক অর্থে গণমাধ্যম হল জনগণের সাথে যােগাযােগের মাধ্যম। ভারতে সাধারণভাবে গণমাধ্যম যথেষ্ট শক্তিশালী। সংবাদপত্রের পাশাপাশি বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মাধ্যমগুলির গুরুত্বও কম নয়। গণমাধ্যম বলতে একত্রে পত্র-পত্রিকা, রেডিও, টিভি, চলচ্চিত্র, ডিসপ্লেবাের্ড প্রভৃতি সবকিছুকেই একত্রিত করে বােঝায়। বর্তমান দিনে এগুলির চাহিদা ও প্রয়ােজনীয়তা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। তার সাথে সাথে এগুলির প্রাসঙ্গিক ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বলা হয় যে গণতন্ত্রের বাস্তবায়নে গণমাধ্যম হল চতুর্থ স্তম্ভ। যাইহােক, গণমাধ্যম বিষয়টিকে আমরা সংজ্ঞায়িত করতে পারি এই রূপে যে, যার মাধ্যমে জনগােষ্ঠীর বৃহৎ অংশের কাছে অতি অল্প সময়ে যােগাযােগ করা যায় অর্থাৎ পৌছানাে যায়। এই একবিংশ শতাব্দীতে গণমাধ্যমের রূপ শুধুমাত্র সেই পত্রিকা বা সাপ্তাহিকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। রেডিও-টেলিভিশন বেশ কিছুদিন আগেই এই সারিতে জায়গা নিয়েছে। আধুনিক সময়ে তাদের সাথে সংযুক্ত হয়েছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে পরিচালিত অন লাইন মিডিয়া, ব্লগ, সােশাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলি। মােবাইল ফোনও তার বিস্তার ঘটিয়েছে।
বর্তমান প্রকল্পটিতে গণমাধ্যমের ধারণা , সমাজজীবনে তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক ভূমিকা - ইত্যাদি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
যে সকল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রকল্পটি রূপায়িত করা হয়েছে , সেগুলি হল -
১. গণমাধ্যম সম্পর্কে সাধারণ ধারণা অর্জন।
২. বিভিন্ন গণমাধ্যমগুলির পরিচয় জানা।
৩. আধুনিককালে গণমাধ্যমের যে প্রকৃতিগত পরিবর্তন হয়েছে - সে সম্পর্কে জানা।
৪. সমাজজীবনে গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রসঙ্গে আলোচনা করা।
৫. গণমাধ্যমের ইতিবাচক দিকগুলি তুলে ধরা।
৬. সমাজজীবনে গণমাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাবগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা।
৭. সর্বোপরি , গণমাধ্যম এবং সমাজ জীবনে তার ভূমিকা বিষয়টিতে শিক্ষার্থীদের কৌতূহলী করে তোলা।
প্রকল্পটির গুরুত্ব :-
যে সকল কারণে প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতে পারে সেগুলি হল -
১. প্রকল্পটির মাধ্যমে গণমাধ্যম সম্পর্কে সাধারণ ধারণা অর্জন সম্ভব।
২. গণমাধ্যমের বিভিন্ন উপাদানগুলির সম্পর্কে জানতে প্রকল্পটি কার্যকর।
৩. সমাজজীবনে গণমাধ্যমের প্রভাব , তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলি সম্পর্কে জানতে প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
৪. আধুনিককালে গণমাধ্যমের প্রকৃতিগত পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে প্রকল্পটি কার্যকর।
৫. সর্বোপরি , প্রকল্পটির মাধ্যমে বিষয়টি সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের কৌতূহলী করে তোলা যেতে পারে।
প্রতিটি মানুষের জীবনধারণের জন্য যেমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান প্রয়ােজন, তেমনি বর্তমানে যােগাযােগও একটি অতি প্রয়ােজনীয় উপকরণ তার কাছে। একুশ শতকের মানুষ চায় তার কাছে সর্বশেষ তথ্যটি থাকুক। এই চাহিদা পূরণ করে গণমাধ্যম। শুধুমাত্র সর্বশেষ তথ্য প্রদানের মধ্যেই গণমাধ্যমের ভূমিকা আজ সীমাবদ্ধ নেই। দৈনন্দিন কর্ম পরিচালনায়, একঘেয়েমি কাটানােয়, বিনােদনে, অন্যান্য আর্থ-সামাজিক প্রয়ােজনে গণমাধ্যম আজ হয়ে উঠেছে অপরিহার্য।
গণতান্ত্রিক দেশে মানুষ স্বাধীনভাবে চিন্তা করে, স্বাধীনভাবে বলে, লেখে, অন্যের সাথে আলােচনা করে, বিশ্লেষণ করে, সমালােচনা করে, এবং স্বাধীনভাবে বিরােধিতা করে। গণমাধ্যম মানুষের এই স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করতে ভূমিকা গ্রহণ করে। গণমাধ্যম সরকারের ঘােষিত বিভিন্ন পরিকল্পনা কর্মসূচির বিষয়ে জনগণকে সচেতন রাখে , কোনাে বিষয়ের উপর জনমত সৃষ্টি করে এবং সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে সেই সংগঠিত জনমত সরকারের কাছে পৌছে দেয়। এভাবে গণমাধ্যম সরকার ও জনগণের যােগসূত্রের কাজ করে। এছাড়াও গণমাধ্যম সরকারের স্বৈরাচারিতা আটকায়। সরকারের নীতিভ্রষ্টতা, মানুষ যেন বৈষম্যের শিকার না হয়—এ সমস্ত দিকে নজর রাখে।
আধুনিককালে গণমাধ্যমের জনপ্রিয় উপাদানগুলি হল - সংবাদপত্র , টেলিভিশন , ইন্টারনেট , ওয়েবসাইট , ব্লগ , সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট - ইত্যাদি। প্রতিটি উপাদান মানুষকে তথ্যে সমৃদ্ধ করে শিক্ষামূলক ভূমিকা পালন করে।
সংগৃহীত তথ্যগুলিকে নীচে বিশ্লেষণ আকারে উপস্থাপন করা হল।
গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকা (Positive role of Mass Media) : -
(১) গণতন্ত্রের সংরক্ষণ ও বিকাশ :- বর্তমান সমাজে গণতন্ত্র ও গণমাধ্যম আমাদের জীবনে দুটি অতি প্রয়ােজনীয় দিক। সত্যিকারের গণতন্ত্র মানুষের অধিকার সংরক্ষণ করে, মানুষকে ক্ষমতা দেয়। আর গণমাধ্যম তা নিশ্চিত করে যােগাযােগ আর স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযােগ সৃষ্টির মাধ্যমে।
(২) সামাজিকীকরণ ভূমিকা : শিক্ষিত সমাজে সামাজিকীকরণের অন্যতম মাধ্যম হল গণমাধ্যম। সংবাদপত্র বা টিভি, রেডিওতে প্রকাশিত কোনাে খবর বা অনুষ্ঠান ব্যক্তির চিন্তাচেতনাকে প্রভাবিত করে ও তাকে সুগঠিত করে।
(৩) সামাজিক নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা : গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন অসামাজিক ঘটনার শাস্তির দিক, নতুন নতুন আইন , সরকার কর্তৃক বিভিন্ন নির্দেশাবলি প্রভৃতি জানতে পেরে আমরা আমাদের ইতিকর্তব্য স্থির করি। এজাতীয় অনুষ্ঠানগুলি বা সংবাদ আমাদের মানসিকতা বা আচার-আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করার সাধ্যমতাে চেষ্টা করে থাকে।
(8) শিক্ষামূলক ভূমিকা :গণমাধ্যমের মধ্য দিয়ে বাস্তবসম্মত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়গুলি উপস্থাপিত হয়। এতে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। চিন্তন প্রক্রিয়ার সক্রিয়তা বাড়ে। গণমাধ্যমের হাত ধরেই জনশিক্ষার বিস্তার, ভাষাজ্ঞান বৃদ্ধি এবং অবসর যাপনের শিক্ষণ বিষয়টি পরিপূর্ণতা পায়। এছাড়াও গণমাধ্যমের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা যুগপােযােগী তথ্যসমৃদ্ধ জ্ঞান লাভের সুযােগ পায়।
(৫) আধুনিকীকরণ : আধুনিকীকরণের বিভিন্ন উপাদানগুলি গণমাধ্যমের দ্বারাই অতি সহজে মানুষের কাছ পর্যন্ত পােছে যায়। নিত্যনতুন ভােগ্যদ্রব্যের বিজ্ঞাপন, সেগলির চিত্তাকর্ষক উপস্থাপন, আমাদের মস্তিষ্ককে নাড়া দেয় এবং সেগুলির পিয়াসী হয়ে পড়ি। বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের কুসংস্কার দূর করতে সাহায্য করে। এভাবে গণমাধ্যম তার সংস্কারমূলক ভূমিকা পালন করে, আমাদের আধুনিক করে।
(৬) এছাড়াও গণমাধ্যম আমাদের বিজ্ঞান মনস্কতা বৃদ্ধি করে, নান্দনিকতা বিকাশ ঘটায়, পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে আমাদের সংযােগ গড়ে দেয়, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ঘটায়, আমাদের পরিতৃপ্তি প্রদান করে , সমাজে নীতিনৈতিকতা ন্যায্যতা নিশ্চিত করা - ইত্যাদি অনেক বড়াে দায়িত্ব পালন করে গণমাধ্যম।
গণমাধ্যমের নেতিবাচক ভূমিকা (Negative Role of Mass Media) : -
গণমাধ্যমের সাফল্য নির্ভর করে গণমাধ্যম পরিচালক ও সংবাদ কর্মীদের উপর। এর থেকে কোনােরূপ বিচ্যুতি গণমাধ্যমের নেতিবাচক দিকগুলিকে প্রকট করে। যেমন -
(১) গণমাধ্যমগুলির নিরপেক্ষতা এখন প্রশ্নচিহ্নের সামনে। একটা সময় ছিল যখন গণমাধ্যম সমূহের অল্পসংখ্যার জন্য তারা যাই সংবাদ পরিবেশন করত তাকে যাচাই করার কোনাে সুযােগ থাকত না। মানুষ সেটাকেই অভ্রান্ত বলে ধরে নিত। বর্তমানে সংবাদপত্রের এবং বিভিন্ন নিউজ চ্যানেলের সংখ্যা বেড়েছে।একই সংবাদ বিভিন্ন মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণে বিশ্লেষিত হয়ে উপস্থাপিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষও বুঝতে পারছে কোন্ মাধ্যমটি কোন্ রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপােষকতা করছে। অনেক সময় মানুষ তাই সংবাদ পড়া বা দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
(২) আর একটি সংশয়ের জায়গা হল অর্থের কাছে গণমাধ্যমের সমর্পণ। বিজ্ঞাপন দাতারা অনেক ক্ষেত্রেই গণমাধ্যমকে তাদের নির্দিষ্ট পথে চালিত করতে বাধ্য করছে। এই বিপজ্জনক প্রবণতা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে স্বস্তির বিষয় নয়।
(৩) কোনাে সংবাদ বা বিষয়কে ঘিরে গণমাধ্যমগুলির মধ্যে প্রতিযােগিতা এমন বাড়াবাড়ি ও সাজানাে বিষয়ের দিকে চলে যায় যা সাধারণ পাঠক, শ্রোতা বা দর্শকের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
(৪) বর্তমানে গণমাধ্যমের শিক্ষামূলক ভূমিকাও অনেকখানি স্তিমিত হয়ে এসেছে। জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি, ব্যাবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, গণমাধ্যমগুলির অনুষ্ঠানকে এমনই অন্তঃসারশূন্য করে তুলেছে যার থেকে শিক্ষা গ্রহণ বিষয়টি নেই বললেই চলে।
(৫) গণমাধ্যম হিসাবে দুরদর্শনের বিজ্ঞাপন এত অতিরঞ্জিত হয় সেগুলি অবাস্তব প্রতিপন্ন হয়। এছাড়াও বহু বিজ্ঞাপন অশ্লীলতা দোষে দুষ্ট। দূরদর্শনের বেশকিছু অনুষ্ঠান, বিশেষ করে বিতর্কসভাগুলি সাজানাে মনে হয়। সেগুলি অনিয়ন্ত্রিত ও বহুক্ষেত্রে অসত্য তথ্য প্রকাশ করে থাকে। দূরদর্শনের প্রভাবে ব্যক্তির নিজস্ব স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি অল্প সময়ের জন্য হলেও স্তন্ধ হয়ে যায়।
(৬) বর্তমান দিনে গণমাধ্যমগুলিকে সস্তা বিনােদনের উপাদান হিসাবে দেখা হয়ে থাকে। এগুলির শিক্ষা ও সংস্কারমূলক ভূমিকা ক্রমে সংকুচিত হয়ে আসছে। হাতে গােনা কিছু বিষয় বাদ দিয়ে বেশির ভাগ অনুষ্ঠান সময় কাটানাের উপাদান হিসাবে বিবেচিত হয়।
(৭) গণমাধ্যমগুলির বিরুদ্ধে এই অভিযােগ আনা হয় যে তারা একই বিষয়কে বারবার পরিবেশনের মধ্য দিয়ে মানুষের চিন্তাশক্তিকে তাদের সেট করা পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ যেন মস্তিষ্কে উপনিবেশ গড়ার মতাে বিষয়।
(৮) গণমাধ্যমগুলি মূলত একমুখী মতামত প্রকাশ করে। কিছু অনুষ্ঠান দ্বিমুখী হলেও সেগুলি হয় Edit করা হয়, অথবা অপছন্দের হলে প্রচার করা হয় না। তাই বেশিরভাগ সময়ই প্রচারিত বিষয়ের উপর ভাব বা মতামত যুক্তি বিনিময় সম্ভব হয় না।
(৯) গণমাধ্যমগুলি মানুষের প্রতি ন্যায় বিচার, মানবিক মুখ প্রদর্শন—এই সকল ভূমিকা কতটা পালন করে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এই সময়ে এমন ঘটনার কথাও শােনা যায়, আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে গায়ে আগুন লাগানাে কাউকে বাঁচানাের পরিবর্তে, গণমাধ্যমকর্মী ক্যামেরায় সেই ফুটেজ তোলাতে বেশি আগ্রহী হয়ে পড়ে। সন্তানহারা মায়ের সামনেই ছেলের কফিনের উপর দাঁড়িয়ে মায়ের কান্নার বাইট নিতেও দেখা গেছে অনেককে।
(১০) বর্তমানের গণমাধ্যম গণতন্ত্র রক্ষা কিংবা আধুনিকতা তৈরিতে কতটা দায়িত্বশীল সে প্রশ্নও রয়েছে। রাজনৈতিক সংবাদ মানেই কোনাে রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপােষকতা করা, আর আধুনিকতার স্থলে উত্তর আধুনিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া—এই ভূমিকাই বেশি চোখে পড়ে।
উপসংহার :-
পরিশেষে বলা যায়, গণমাধ্যম ব্যক্তিমাত্রেরই পছন্দের বিষয়। তা যদি পক্ষপাতদুষ্ট, বিরক্তিকর হয়ে ওঠে, যদিব্যাপক জনমানুষের কল্যাণের বিষয়টি তার মধ্যে প্রকট না হয়, সাংবাদিক যদি তার পেশাদারিত্বের জন্য নীতিবােধ থেকে সরে আসে, সে মাধ্যম জনমানসে বেশিদিন স্থায়ী হয় না বা জনগণ তাকে ক্ষমা করে না।
গ্রন্থপঞ্জি :-
যেসকল গ্রন্থগুলি প্রকল্পটি রূপায়ণ করতে সহায়তা করেছে সেগুলি হল -
১. উচ্চমাধ্যমিক সমাজতত্ত্ব - অরুনাংশু প্রধান।
২. ভারতীয় সমাজ - অনাদিকুমার মহাপাত্র।
৩. ভারতের সামাজিক সমস্যা - বাণী প্রকাশন।
0 comments