উচ্চমাধ্যমিক সমাজতত্ত্ব প্রকল্প : বর্তমান সমাজে নারীদের অবস্থান।
উচ্চমাধ্যমিক সমাজতত্ত্ব প্রকল্প : বর্তমান সমাজে নারীদের অবস্থান।
H.S. Sociology Project : বর্তমান সমাজে নারীদের অবস্থান।
বর্তমান সমাজে নারীদের অবস্থান।
ভূমিকা :-
নারী ও পুরুষ - জৈবিক নিয়মে কিছু দৈহিক পার্থক্য নিয়ে সৃষ্ট। মানব সভ্যতার প্রসার ও অস্তিত্ব রক্ষায় উভয়ের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। কিন্তু যুগ যুগ ধরে নারীসমাজ পুরুষের হাতে বঞ্চিত ও শোষিত হয়ে এসেছে। সামাজিক মর্যাদা , রাজনৈতিক অধিকার , ধর্মীয় কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ - ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই দীর্ঘকাল যাবৎ নারীদের বঞ্চিত করে রাখা হয়েছিল। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের ইচ্ছা - অনিচ্ছা সবকিছুই আবর্তিত হয়েছে পুরুষের সম্মতিক্রমে। নারীরা ছিলেন সর্বত্র দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ।
কিন্তু বর্তমান সমাজে নারীদের মর্যাদাগত অবস্থানের কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে। শিক্ষার বিস্তার , বিভিন্ন নারী আন্দোলন , সমাজ সংস্কার , সাংবিধানিক বিধি - ব্যবস্থা , পাশ্চাত্যের প্রভাব , আধুনিকীকরণ ও উদারীকরণ এবং বিশ্বায়নের প্রভাব , নগরায়নের বিস্তার - ইত্যাদির ফলে বর্তমান সমাজে নারীদের অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক , সামাজিক - ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে নারীদের মর্যাদাগত অবস্থানের পরিবর্তন ঘটেছে।
বর্তমান প্রতিবেদনমূলক প্রকল্পটিতে নারীদের বর্তমান সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে আলোচনা করার সঙ্গে সঙ্গে নারীদের মর্যাদাগত অবস্থানের পরিবর্তনের কারণ , বর্তমান সময়েও নারীরা কোন কোন ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার , উল্লেখ্য সাংবিধানিক ব্যবস্থা - ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য :-
যেসকল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রকল্পটি রচনা করা হয়েছে সেগুলি হল -
১. বর্তমান সমাজে নারীদের মর্যাদাগত অবস্থানের বাস্তব রূপটি তুলে ধরা।
২. বর্তমান সময়ে নারীদের মর্যাদাগত অবস্থানের পরিবর্তনের কারণগুলি আলোচনা করা।
৩. নারীদের বিরুদ্ধে ঘটে আজও চলা নানা ধরণের নির্যাতনের রূপরেখা তৈরী করা।
৪. পণপ্রথা কিভাবে আমাদের বর্তমান সমাজেও নারীদের কাছে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে আছে - সে সম্পর্কে আলোচনা করা।
৫. নারী অধিকার সুরক্ষায় যে সকল বিধিবদ্ধ আইন বর্তমান - সেগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা।
৬. নারী সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন সাংবিধানিক ব্যবস্থা থাকা স্বত্ত্বেও কীভাবে নারীরা আজও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে - সে সম্পর্কে আলোচনা করা।
৭. সর্বোপরি নারীদের বর্তমান সমস্যাগুলি সমাধানের উদ্দেশ্যে যুক্তিযুক্ত আলোচনা করা।
প্রকল্পের গুরুত্ব :-
যেসকল কারণে প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতে পারে সেগুলি হল -
১. প্রকল্পটির মাধ্যমে নারীদের বর্তমান সামাজিক মর্যাদাগত অবস্থান সম্পর্কে জানা সম্ভব।
২. বর্তমান সমাজে নারীদের বিরুদ্ধে সংগঠিত বিভিন্ন অপরাধমূলক আচরণ এবং তার প্রকৃত রূপ সম্পর্কে জানা সম্ভব।
৩. প্রকল্পটির মাধ্যমে নারী সুরক্ষায় নিয়োজিত বিভিন্ন আইনগুলি সম্পর্কে জানা সম্ভব। নারীসুরক্ষার বিষয়টিকে জোরালো করতে এইসকল আইনগুলি সম্পর্কে সকলের ধারণা থাকা উচিত।
৪. বর্তমান সমাজে পণপ্রথার বাস্তব রূপ সম্পর্কে প্রকল্পটিতে আলোচনা করা হয়েছে। ফলে বর্তমান সমাজেও কিভাবে পণপ্রথা টিকে আছে এবং কিভাবে তার ভয়াবহ প্রভাব বিস্তার করছে - তা উপলব্ধি করা সম্ভব।
৫. সর্বোপরি প্রকল্পটির মাধ্যমে নারীসমাজের সমস্যাগুলির সমাধানের লক্ষ্যে সাধারণ সূত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
কর্মপরিকল্পনা / পদ্ধতিগত দিক :-
প্রকল্পটি রূপায়ণ করতে যেসকল পদ্ধতি ও পরিকল্পনা অনুসরণ করা হয়েছে সেগুলি হল -
---> বিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিষয়ের মাননীয়া শিক্ষিকা X মহাশয় / মহাশয়া কর্তৃক প্রকল্পের বিষয়বস্তু নির্বাচন।
---> বিষয় নির্বাচনের পর মাননীয় শিক্ষক মহাশয় / মাননীয়া শিক্ষিকা মহাশয়া - প্রকল্প রূপায়ণের জন্য প্রয়োজনীয় পদ্ধতিগত দিকগুলি সম্পর্কে আলোকপাত করেন।
---> মাননীয় শিক্ষক মহাশয় / মাননীয়া শিক্ষিকা মহাশয়া - র নির্দেশমত বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠ করে প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
---> সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে একটি খসড়া প্রতিবেদন রচনা করে সেটি মাননীয় শিক্ষক / মাননীয়া শিক্ষিকার নিকট উপস্থাপন করা হয় এবং তিনি প্রয়োজনীয় সংশোধনের নির্দেশ প্রদান করেন।
---> মাননীয় শিক্ষক / মাননীয়া শিক্ষিকার নির্দেশমত প্রয়োজনীয় সংশোধনের পর পুনরায় প্রকল্পটি প্রস্তুত করা হয়।
---> প্রয়োজনীয় চিত্র সংগ্রহ করে সেগুলি প্রতিবেদনে সংযোজিত করা হয়।
---> পূর্ণাঙ্গ প্রকল্পটি বিদ্যালয়ে জমা দেওয়া হয়।
তথ্য সংগ্রহ / পরীক্ষামূলক উপাদান :-
বর্তমান সময় ও সমাজে নারীদের মর্যাদাগত অবস্থানের পরিবর্তন ঘটেছে - সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। নারীসমাজের এই মর্যাদাগত অবস্থানের পরিবর্তন ঘটার পেছনে বিভিন্ন কারণ বর্তমান। যেমন -
(i) বিভিন্ন আইন :- ভারতীয় সংবিধানে উল্লিখিত বিভিন্ন আইনগুলি নারী সুরক্ষা ও নারী অধিকার রক্ষায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। এই আইনগুলির দ্বারা পুরুষের বহুগামিতা বন্ধ করা গেছে , নারীদের বিবাহের ন্যুনতম বয়স ১৮ বছর আইনসিদ্ধ হয়েছে , স্ত্রী ও কন্যার সমানাধিকারের বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে , পণপ্রথা বহুলাংশে প্রতিরোধ করা গেছে - ইত্যাদি। এই আইনগুলির মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল - Hindu Marriage Act 1955, Hindu Succession Act 1956, The Dowry Prohibition Act 1961 ইত্যাদি।
(ii) সাংবিধানিক ব্যবস্থা :- ভারতীয় সংবিধানের ১৪ - ৩০ নং ধারা পর্যন্ত যেসকল মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতার অধিকার দেওয়া হয়েছে সেগুলি নারীদের মর্যাদাগত অবস্থানের প্রভূত উন্নতি ঘটিয়েছে। মৌলিক অধিকার , ১৪ - ১৮ নং ধারায় সাম্যের অধিকার , ২৩ - ২৪ নং ধারায় শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার , ২৯ - ৩০ নং ধারায় সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার - ইত্যাদি বিষয়গুলি নারীদের মর্যাদার উন্নীতকরণ ও নারী সুরক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
(iii) শিক্ষার প্রসার :- স্বাধীনতা পূর্ববর্তী যুগে রামমোহন , বিদ্যাসাগরের হাত ধরে নারীশিক্ষা আন্দোলনের যে সূত্রপাত ঘটেছিল স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী সময়ে তা অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বিস্তারলাভ করতে থাকে। ১৯৭৬ সালে সংবিধানের ৪২ তম সংশোধনের মধ্যে দিয়ে ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলি নারীশিক্ষা বিস্তারে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণের সুযোগ লাভ করে। এছাড়াও ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে রাধাকৃষ্ণন কমিশন , ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে কোঠারি কমিশন , ১৯৬৮ তে জাতীয় শিক্ষানীতি , ১৯৮৬ - র জাতীয় শিক্ষানীতি - সকল শিক্ষা কমিশনগুলিই নারীশিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেন। এছাড়াও , অপারেশন ব্ল্যাকবোর্ড , জাতীয় সাক্ষরতা মিশন , জাতীয় বয়স্ক শিক্ষা কর্মসূচি , সর্বশিক্ষা অভিযান - ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে ভারতে নারীশিক্ষার প্রভূত বিস্তার ঘটেছে।
(iv) অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক কর্মসূচি :- স্বাধীন ভারতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে যেসকল কর্মসূচি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলি যে শুধুমাত্র পুরুষদের উন্নতি ঘটিয়েছে - এমনটা নয় ; মহিলারা এর সুফল থেকে বঞ্চিত হননি। তবে ভারতীয় মহিলাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রধানত তিনটি আইন প্রভূত সহায়তা করে। এই তিনটি আইন হল - Hindu Succession Act 1956 , Factory Act 1948 , Equal Remuneration Act 1976 । এছাড়াও শুধুমাত্র মহিলাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে গৃহীত কর্মসূচীগুলি হল - CPWC , DWCRA , ICDS , SGSY - ইত্যাদি।
(v) সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মসূচি :- বর্তমানে নারীদের সামাজিক কল্যাণ সাধনে যে মন্ত্রকগুলি কাজ করে সেগুলি হল - মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক , স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক , স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক , মহিলা ও শিশু বিকাশ মন্ত্রক - ইত্যাদি। এদের মাধ্যমে নারীদের নানাবিধ কল্যাণমূলক কর্মসূচি রূপায়িত হয়েছে ও নারীদের সামাজিক মর্যাদার উন্নয়ন ঘটেছে।
(vi) রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন :- রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ও পদাধিকারের মাধ্যমে মহিলাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সংবিধানের ৭৩ তম সংশোধনীর দ্বারা পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরের মোট আসনের এক - তৃতীয়াংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। এভাবে অবধারিত রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে সমাজে নারীদের প্রতি শোষণ কিছু অংশে লাঘব হয়েছে এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের স্বনির্ভর হওয়ার প্রবণতা অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে।
(vii) বিবিধ স্বাস্থ্য কর্মসূচি :- ICDS এর মাধ্যমে সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্প , WHO এর উদ্যোগে State Health Systems Development Project , ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রক - এদের মাধ্যমে মহিলাদের বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে সচেতন করা , চিকিৎসার ব্যবস্থা করা , গর্ভবতী ও প্রসূতিকালীন মহিলাদের বিশেষ পরামর্শ ও চিকিৎসার তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসা , প্রয়োজনীয় টীকা ও প্রতিষেধক প্রদান করা - ইত্যাদির মাধ্যমে নারীরা নিজেদের স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠেছেন। নারীদের মর্যাদাগত অবস্থানের পরিবর্তনের এটিও একটি বড় কারণ।
(viii) কর্মক্ষেত্রে নারীদের স্বাধীনতা বৃদ্ধি :- বর্তমানে কর্মক্ষেত্রে নারীরা সমানাধিকার লাভ করেছেন। শিক্ষার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে নারীদের যোগদান বিগত ৫০ বছরের তুলনায় কয়েকশো গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আজ বহুসংখ্যক নারীরা বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে , বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে , BPO , Call Centre - ইত্যাদি ক্ষেত্রে সফলভাবে কর্মরতা। এছাড়াও বর্তমান প্রজন্মের নারীদের মধ্যে ব্যবসায়িক প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারীরা অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্মে যুক্ত থাকবে না - এই ধরণের চিন্তাগুলিরও পরিবর্তন ঘটছে।
(ix) কর্মক্ষেত্রে নারী নির্যাতন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা :- বর্তমানে প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে নারীদের বিরুদ্ধে ঘটে চলা বিভিন্ন নির্যাতনমূলক আচরণগুলির বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিটি দপ্তরে নারীদের যৌন লাঞ্ছনা , হেনস্থা - পৃথক পৃথক কমিটি গঠনের ব্যবস্থা রয়েছে এবং এই সকল ক্ষেত্রে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে কর্মক্ষেত্রে নারীদের জন্য স্বাধীন পরিবেশ গঠনের কাজ অনেকটাই এগিয়েছে।
(x) পারিবারিক ক্ষেত্রে নারী ক্ষমতায়ন :- শিক্ষার বিস্তার , রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন , অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা - ইত্যাদির কারণে বর্তমানে নারীরা নিজেদের প্রতি ঘটে যাওয়া পারিবারিক শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এরফলে পারিবারিক ক্ষেত্রে নারীদের ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পেয়েছে।
(xi) বর্তমান সমাজে নারীদের বিভিন্ন সমস্যা :- তবে এসব স্বত্ত্বেও নারীদের মর্যাদা যে সম্পর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সকল প্রকার বৈষম্যের অবসান ঘটেছে - এমন কথা বলা যাবেনা। আজও বহু ক্ষেত্রে নারীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে লাঞ্ছনা ও বৈষম্যের শিকার হতে হয়। যেমন -
(a) আজও ভারতীয় সমাজ পুরুষতান্ত্রিক। তাই কাগজে কলমে নারীদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হলেও বাস্তবে বহু বিপরীত চিত্র দেখা যায়।
(b) পারিবারিক ক্ষেত্রেও নারীরা আজও পুরুষদের অধীন। নারীর স্বাধীনতা ও অধিকার নির্ভর করে পুরুষের সম্মতির উপর।
(c) প্রাথমিক ও মাধ্যমিক ক্ষেত্রে নারীশিক্ষার যথেষ্ট বিকাশ ঘটলেও নারীদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার ক্ষেত্রে ইতিবাচক মানসিকতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
(d) বিবাহের পর শিক্ষা ও কর্মসংস্থান উভয়ই সম্পূর্ণরূপে পুরুষের সম্মতির উপর নির্ভরশীল।
(e) সমাজে পুরুষদের তুলনায় নারীদের অনেক বেশি সংস্কার , প্রথা , রীতিনীতি মান্য করে চলতে হয়। পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসন নারীজীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠে।
(f) বর্তমান সমাজে সতীদাহের মত মধ্যযুগীয় প্রথা প্রচলিত না থাকলেও তার আধুনিক রূপ নিয়েছে পরিবারের সম্মানার্থে হত্যা।
(g) খুব কম হলেও বাল্য বিবাহ আজও ঘটে চলেছে। কিছু ঘটনা প্রতিরোধ করা গেলেও লোকচক্ষুর আড়ালে বাল্যবিবাহের কত ঘটনা যে ঘটে চলেছে - তার কোনো হিসেবে নেই।
(h) আজও মধ্যবিত্ত , নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলির মধ্যে নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও মর্যাদার বিষয়টি খুব একটা গুরুত্ব পায়না। বহু ক্ষেত্রেই সংসার বা পারিবারিক চাপে নারীদের চাকরি ছাড়তে হয়।
(i) কর্মরতা নারীদের আজও বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। যেমন ভারতে কৃষিকাজে নিযুক্ত মহিলারা বছরে ৬/৭ মাস কর্মহীন অবস্থায় থাকেন। সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা স্বত্ত্বেও বহু ক্ষেত্রেই পুরুষদের তুলনায় নারীদের পারিশ্রমিক কম দেওয়া হয়।
(j) UNICEF এর রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে পুরুষদের তুলনায় নারীরা অধিক অপুষ্টিতে ভোগেন।
(k) আজও আইন ও সরকারি নির্দেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কন্যাভ্রূণ হত্যার ঘটনা ঘটে।
তথ্য বিশ্লেষণ :-
সংগৃহীত তথ্যগুলিকে নীচে বিশ্লেষণ আকারে উপস্থাপন করা হল।
১. ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত বিভিন্ন আইনগুলি ভারতীয় নারীদের মর্যাদাগত বিবর্তনের ক্ষেত্রে ও সুরক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই সাংবিধানিক স্বীকৃতি নারীদের অধিকারের বিষয়টিকে একটি বিধিবদ্ধ ও আইনগত বিষয়ে পরিণত করেছে।
২. ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত স্বাধীনতা ও সাম্যের অধিকার এবং মৌলিক অধিকারগুলিতে নারী ও পুরুষ উভয়কেই সমান মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই স্বাধীনতালাভের পরবর্তীকালে নারীদের অধিকারের বিষয়টি দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এ বিষয়ে নারীরা সচেতন হয়েছেন।
৩. নারী অধিকার ও মর্যাদার বিষয়টিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে শিক্ষার প্রসার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের ফলে তারা নিজেদের অধিকার ও মর্যাদা বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠেছেন।
৪. স্বাধীনতার পরবর্তীকালে গ্রাম ও শহরের নাগরিকদের জন্য পৃথক পৃথক অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এই অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক কর্মসূচিগুলির দ্বারা গ্রাম ও শহরের মহিলাগণ অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হয়ে উঠেছে। ফলে তাদের সামাজিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
৫. বিশেষভাবে নারীদের জন্য গৃহীত বিভিন্ন সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মসূচি নারীদের সামাজিক মর্যাদার স্তর উন্নত করেছে।
৬. স্বাধীনতার পরবর্তীকালে সাংবিধানিক ব্যবস্থাদির মাধ্যমে ভারতে নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর ফলে নারীরা যেমন একদিকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হয়েছেন তেমনি অন্যদিকে নারীদের বিভিন্ন সমস্যাগুলিকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে উপস্থাপন করে আন্দোলন পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছেন।
৭. যুগ যুগ ধরে নারীদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়টি অবহেলিত ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তীকালে নারীদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এর ফলে বিভিন্ন রোগ ও তার প্রতিকার সম্পর্কে নারীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং গর্ভবতী মহিলা ও সন্তান প্রসবের পর মা ও সন্তান উভয়ের বিভিন্ন টীকা , যথার্থ পুষ্টি - ইত্যাদি বিষয়গুলি কিছুটা হলেও সুনিশ্চিত করা গেছে।
৮. আধুনিক ভারতে কর্মক্ষেত্রে নারীদের স্বাধীনতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাড়ির বাইরে গিয়ে নারীরা কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করবে - এইরূপ মানসিকতা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নারীদের মধ্যে ব্যবসায়িক উদ্যোগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
৯. বিভিন্ন বিধিবদ্ধ ব্যবস্থার মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে নারীদের যৌন হয়রানি ও অন্যান্য হেনস্থা প্রতিরোধের চেষ্টা করা হয়েছে। এর ফলে কর্মক্ষেত্রে নারীদের সুরক্ষা বৃদ্ধি পেয়েছে।
১০. তবে নারী নির্যাতনের সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান সম্ভব হয়নি এবং নারীদের অধিকার পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা করা গেছে - এমনটাও বলা যাবে না। পণপ্রথা , বাল্যবিবাহ , কন্যাভ্রূণ হত্যার মত ঘৃণ্য ঘটনা , পণের দায়ে বধূহত্যার মত জঘন্যতম অপরাধ , ধর্ষণ , শ্লীলতাহানির মত কার্যকলাপ প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে। প্রশাসনিক উদাসীনতা , রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব , দুর্নীতি , পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো - ইত্যাদির কারণে নারীরা আজও পূর্ণ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পারেননি।
উপসংহার :-
সামগ্রিক আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে , বর্তমান সমাজে নারী অধিকার ও মর্যাদার বিবর্তনের বিষয়টি কিছুটা আলোকিত ও কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আছে। আইন , আদালত , কমিশন , কমিটি - এই সবের বাইরেও এমন কিছু ঘটছে যা নারীরাই নিভৃতে রাখতে চান ; কেননা এর সাথে জড়িত থাকে তাদের কেরিয়ার , পেশাগত বিষয়। আবার অনেক সময় আপসহীন সংগ্রামের মানসিকতাও সকলের থাকেনা। তাই পরিশেষে বলা যেতে পারে - নারীদের বিরুদ্ধে ঘটে চলা প্রত্যেকটি অন্যায় অত্যাচারের কথা নারীদেরকেই সামনে নিয়ে আসতে হবে - তাহলেই জোটবদ্ধ হবে সমাজ , শুভচেতনা জাগ্রত হয়ে উঠবে এবং সমাজে বিবর্তনের পথে নারী - মর্যাদা অধিকতর উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হবে।
পাঠের সীমাবদ্ধতা :-
প্রকল্পটি রূপায়ণ করতে গিয়ে এবং রূপায়ণ করার পর যেসকল ত্রুটি - বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতা দৃষ্টিগোচর হয়েছে - সেগুলি হল -
(ক ) প্রকল্প রচনার সীমাবদ্ধ পরিসরে নারীদের বর্তমান অবস্থা ও মর্যাদাগত বিবর্তন বিষয়টিকে আলোচনা করা হয়েছে। তাই প্রতিটি অংশকে সংক্ষিপ্ত আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে। বহু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন ছিল - কিন্তু তা করা হয়নি।
(খ ) বিভিন্ন আইন নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নারী সুরক্ষার জন্য রচিত হলেও , এখনও এমন বেশ কিছু আইন আছে যা নারী মর্যাদা ও স্বাধীনতার পরিপন্থী। এই সকল আইনগুলিকে তুলনামূলক পদ্ধতিতে সমালোচনামূলক আলোচনা করা প্রয়োজন ছিল।
(গ ) নারীদের মর্যাদার অবমাননার বিষয়ে বহু ক্ষেত্রেই নারীরাও বিভিন্নভাবে দায়ী থাকেন। এ প্রসঙ্গে প্রকল্পটিতে কোনো আলোচনা নেই।
(ঘ ) বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীসুরক্ষা আইনগুলি আরো বিশদে আলোচনা করা প্রয়োজন ছিল।
(ঙ ) বর্তমান যুগে বিভিন্ন নারী সংগঠন রয়েছে - যারা নারীদের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া অবমাননা ও লাঞ্ছনার প্রতিকারের জন্য কাজ করে থাকেন। এই প্রতিবেদনটিতে সেই সকল সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলির কার্যাবলীর বিষয়ে কোনো আলোচনা উপস্থাপন করা হয়নি।
(চ ) নারীদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে প্রতিবেদনটি রচিত হলেও তাদের বাস্তব অবস্থা জানার জন্য নিজস্ব এলাকায় সমীক্ষা করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি।
গ্রন্থপঞ্জি :-
প্রতিবেদনটি রচনার জন্য তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে যে সকল গ্রন্থের সাহায্য নেওয়া হয়েছে - সেগুলি হল -
১. উচ্চমাধ্যমিক সমাজতত্ত্ব - ডক্টর অরুনাংশু প্রধান।
২. উচ্চমাধ্যমিক সমাজবিদ্যা - ডক্টর মৃনাল কান্তি দত্ত।
৩. বি এ ভারতীয় সামাজিক সমস্যা - বাণী প্রকাশন।
৪. রাজনীতিক সমাজতত্ত্ব ( স্নাতক ) - অনাদিকুমার মহাপাত্র।
৫. ভারতীয় সমাজ ( স্নাতক ) - অনাদিকুমার মহাপাত্র।
[ কৃতজ্ঞতা স্বীকার , অভিজ্ঞানপত্র বা শংসাপত্র - ইত্যাদি যদি প্রয়োজন হয় তাহলে তা এই ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে। '' সমস্ত প্রকল্পের তালিকা '' - Page - টি তে একটু খুঁজলেই পেয়ে যাবে। ]
0 comments