মহেশ গল্পের নাট্যরূপ :- Dramatisation of Mahesh

by - July 28, 2021

মহেশ গল্পের নাট্যরূপ :- 


প্রথম দৃশ্য :- 

মঞ্চসজ্জা - দৃশ্যটি একটি ফাঁকা মঞ্চেও উপস্থাপিত করা যেতে পারে। তবে দৃশ্যটিকে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। যেমন - চিত্রের মাধ্যমে বা ক্যানভাসের মাধ্যমে গ্রামের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা যেতে পারে। তাছাড়া মঞ্চের একদিকে কার্ডবোর্ড ইত্যাদি দিয়ে একটি পর্ণকুটির নির্মাণ করা যেতে পারে। এতে যাওয়া - আসার জন্য একটি দরজা থাকবে। 

তর্করত্ন মঞ্চে কয়েকবার প্রদক্ষিণ করবেন। যাতে দর্শকদের নিকট প্রতিভাত হয় যে তিনি রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছেন। তর্করত্ন অত্যন্ত বিরক্ত এবং গ্রীষ্মের দাবদাহে অত্যন্ত ক্লান্ত। ধীরে ধীরে তিনি কুটিরের সামনে আসলেন। 



তর্করত্ন : গফরা  .......... এই গফরা  .......... ওরে ও গফরা , বলি ঘরে আছিস ? গফরা ! 

[ গফুরের বছর দশেকের মেয়ে আমিনা কুটিরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসলো। ]

আমিনা : ডাকছো কেন বাবাকে ? বাবার যে জ্বর ! 

তর্করত্ন : ( অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ) : জ্বর ! ডেকে দে হারামজাদাকে। পাষন্ড ! ম্লেচ্ছ ! ( কুটিরের দরজার পাশ দিয়ে তাকিয়ে ) গফরা  ........ এই গফরা  .......... বেরিয়ে আয় হতচ্ছাড়া ! 

[ এই হাঁকডাকে গফুর মিঞা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। সে জ্বরে কাঁপছে ; সে অত্যন্ত ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত। ]

তর্করত্ন :  ( মঞ্চের একটি বিশেষ দিকের প্রতি ইঙ্গিত করে ) ওটা কী হচ্ছে শুনি ? এ হিঁদুর গাঁ , ব্রাহ্মণ জমিদার , সে খেয়াল আছে ?  ............. ( আরো রেগে গিয়ে ) সকালে যাওয়ার সময় দেখে গেছি ষাঁড়টা বাঁধা ; দুপুরে ফেরার পথে দেখছি তেমন ঠাঁই বাঁধা। গো হত্যা হলে যে কর্ত্তা তোকে জ্যান্ত কবর দেবে। সে যে - সে বামুন নয় ! 

গফুর : ( হাত জোড় করে বিনীতভাবে ) কী করবো বাবাঠাকুর , বড় লাচারে পড়ে গেছি। ক'দিন থেকে গায়ে জ্বর। দড়ি ধরে যে দু খুঁটো খাইয়ে আনবো  ................ তা মাথা ঘুরে পড়ে যাই। 

তর্করত্ন : ( অত্যন্ত ক্ষুব্ধ স্বরে ) তবে ছেড়ে দে না , আপনি চড়াই করে আসুক। 

গফুর : কোথায় ছাড়বো বাবাঠাকুর , লোকের ধান এখনো সব ঝাড়া হয়নি ; খামারে পড়ে ; খড় এখনো গাদি দেওয়া হয়নি , মাঠের আলগুলো সব জ্বলে গেল - কোথাও এক মুঠো ঘাস নেই। কার ধানে মুখ দেবে , কার গাদা ফেঁড়ে খাবে - ক্যামনে ছাড়ি বাবাঠাকুর ? 

তর্করত্ন : ( আগের চেয়ে একটু নরম গলায় ) না ছাড়িস তো ঠান্ডায় কোথাও বেঁধে দিয়ে দু - আঁটি বিচুলি ফেলে দে'না  ............. ততক্ষন চিবোক।  ................ তোর মেয়ে ভাত রাঁধেনি ? ফ্যানে - জলে দে'না এক গামলা খাক। 
( গফুর হাত জোড় করে নিরুত্তর থাকলো ) 
ও  ........... তা'ও নেই বুঝি ? কী করলি খড় ? ভাগে এবার যা পেলি সমস্ত বেচে পেটায় নমঃ ? গরুটার জন্য এক আঁটি ফেলে রাখতে নেই ? ব্যাটা কসাই ! 

গফুর : ( প্রথমে অত্যন্ত অবাক হয় ; তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করে ) কাহন খানেক খড় এবার ভাগে পেয়েছিলাম , কিন্তু গেল সনের বকেয়া বলে কর্ত্তামশাই সব ধরে রাখলেন। ................. কেঁদে কেটে হাতে পায়ে পড়ে বললাম , বাবুমশাই , হাকিম তুমি , তোমার রাজত্বি ছেড়ে আর পালাবো কোথায় , আমাকে পণ দশেক বিচুলি না হয় দাও। চালে খড় নেই  ................. একখানি ঘর  ............... বাপ - বেটিতে থাকি  ....................... তা'ও না হয় তালপাতার গোঁজা দিয়ে এ বর্ষাটা কাটিয়ে দেব , কিন্তু খেতে না পেলে আমার মহেশ মরে যাবে। 



তর্করত্ন : ( ব্যাঙ্গের হাসি হেসে ) ইস ! সাধ করে আবার ষাঁড়ের নাম রাখা হয়েছে মহেশ ! হেসে বাঁচি নে ! 

গফুর : কিন্তু হাকিমের দয়া হল কই বাবাঠাকুর ! মাস দুয়েকের খোরাকের মত ধান দুটি আমাদের দিলেন  .................. কিন্তু খড় বেবাক সরকারের গাদা হয়ে গেল , .................... মহেশ  ................... আমার কুটোটি পেল না। 

তর্করত্ন : আচ্ছা মানুষ তো তুই ! ধান খেয়ে রেখেছিস - খাজনা দিবি নে ? জমিদার কি তোকে ঘর থেকে খাওয়াবে না'কি ? তোরা তো রাম রাজত্বে বাস করিস - ছোটলোক কি'না , তাই তাঁর নিন্দে করে মরিস ! 

গফুর : ( লজ্জিত হয়ে ) নিন্দে করবো কেন বাবাঠাকুর , নিন্দে তাঁর আমরা করিনে। কিন্তু কোথা থেকে দিই বল তো ? বিঘে চারেক জমি ভাগে করি , কিন্তু উপরি উপরি দু - সন অজন্মা  - মাঠের ধান শুকিয়ে গেল - বাপ মেয়েতে দু বেলা দুটো পেট ভরে খেতে পর্যন্ত পাইনে। ঘরের পানে চেয়ে দেখ - বৃষ্টি বাদলে মেয়েটিকে নিয়ে ঘরের কোণে বসে রাত কাটাই , পা ছড়িয়ে শোবার ঠাঁই মেলেনা। মহেশকে একটিবার তাকিয়ে দেখ , পাঁজরা গোনা যাচ্ছে - দাও না ঠাকুরমশাই , কাহন দুই ধার , গরুটাকে দুদিন পেটপুরে খেতে দিই। 

[ একথা বলেই গফুর তর্করত্নের পায়ে পড়লো। তর্করত্ন সঙ্গে সঙ্গে দু পা পিছিয়ে গেলেন। ] 

তর্করত্ন : ( সচকিত ভাবে ) আ মোলো যা , ছুঁয়ে ফেলবি না'কি ? 

গফুর : না বাবাঠাকুর , ছোঁব কেন , ছোঁব না। কিন্তু দাও এবার আমাকে কাহন দুই খড়। তোমার চার - চারটে গাদা , সেদিন দেখে এসেছি। দু কাহন ধার দিলে তুমি টেরও পাবেনা। আমরা না খেয়ে মরি ক্ষেতি নেই , কিন্তু মহেশ  ..................... ও তো অবলা জীব  .............. কথা বলতে পারে না , শুধু চেয়ে থাকে , আর চোখ দিয়ে জল পড়ে। 

তর্করত্ন : ধার নিবি ? শুধবি কী করে শুনি ? 

গফুর : ( আশান্বিত হয়ে ) যেমন করে পারি শুধবো বাবাঠাকুর। তোমাকে ফাঁকি দেব না। 

তর্করত্ন : ( তাচ্ছিল্যের স্বরে ) ফাঁকি দেব না ! যেমন করে পারি শুধবো ! রসিক নাগর ! যা যা পথ ছাড়। ঘরে যাই বেলা হয়ে গেল। 

[ তর্করত্ন তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে প্রস্থান করলেন। গফুর অত্যন্ত বেদনার্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইল। ]

গফুর : মহেশ , তুই আমার ছেলে , তুই আমাদের আট সন প্রতিপালন করে বুড়ো হয়েছিস , তোকে আমি পেটপুরে খেতে দিতে পারিনে - কিন্তু তুই তো জানিস তোকে আমি কত ভালোবাসি। .................. এই দুর্বচ্ছরে তোকে কেমন করে বাঁচিয়ে রাখি বল ? ছেড়ে দিলে তুই পরের গাদা ফেঁড়ে খাবি , মানুষের কলাগাছে মুখ দিবি - তোকে নিয়ে আমি কী করি ! গায়ে আর তোর জোর নেই , দেশের কেউ তোকে চায়না - লোকে বলে গো হাটায় বেচে ফেলতে  ..................... আমিনা  ............... এই আমিনা  ............ দুটো পুরোনো খড় মহেশের সামনে ফেলে দে'না মা , .................. 

আমিনা : সে দিই বাবা  .................. কিন্তু তুমি আগে ভাত খাবে এস।  ( হঠাৎ ঘরের দিকে তাকিয়ে ) বাবা , তুমি আবার মহেশকে চাল ফেঁড়ে খড় দিয়েছো ? 

গফুর : ( লজ্জিত ) পুরোনো পচা খড় মা  .................. আপনিই ঝড়ে যাচ্ছিল। 

আমিনা : আমি যে ভেতর থেকে শুনতে পেলাম বাবা , তুমি টেনে বের করেচ। 

গফুর : না মা  ................ ঠিক টেনে নয় বটে  ............. 

আমিনা : কিন্তু দেওয়ালটা যে পড়ে যাবে বাবা ! 

গফুর : সে কি আমি জানিনে মা  ............. একমাত্র ঘর ছাড়া তো আমাদের সবই গিয়েছে। এমন চলতে থাকলে আগামী বর্ষা পর্যন্ত এ ঘর টিকবে না। 

আমিনা : ( প্রসঙ্গ পাল্টে ) হাত ধুয়ে খেতে এস বাবা , আমি বেড়ে দিয়েছি। 

গফুর : ফ্যানটুকু দে তো মা , একেবারে খাইয়ে দিয়ে যাই। 

আমিনা : ফ্যান যে আজ নেই বাবা , হাঁড়িতেই মরে গেছে। 

গফুর : ( হতাশ হয়ে ) নেই ! 

আমিনা : ( মৃদু স্বরে ) তুমি চল , খেয়ে নাও। 

[ মঞ্চের একপাশে আমিনা গফুরের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে শুরু করলো। গফুর এসে সেখানে বসলো। ] 



গফুর : আমিনা , আমার গায়ে যে আবার শীত করে মা , .............. জ্বর গায়ে কি খাওয়া ভাল ? 

আমিনা : কিন্তু তখন যে বললে , বড় খিদে পেয়েছে ! 

গফুর : তখন হয়ত জ্বর ছিল না মা ! 

আমিনা : তাহলে তুলে রেখে দিই , সাঁঝের বেলা খেও। 

গফুর : ( মাথা নেড়ে ) কিন্তু ঠান্ডা ভাত খেলে যে অসুখ বাড়বে আমিনা ! 

আমিনা : তবে ? 

গফুর : ( একটু চিন্তা করে ) এক কাজ কর না মা , মহেশকে না হয় ধরে দিয়ে আয়। তখন রাতের বেলা আমাকে একমুঠো ফুটিয়ে দিতে পারবিনে মা , ..... আমিনা ? 

আমিনা : ( এক মুহূর্ত চুপ থাকার পর ) পারবো বাবা।  

দ্বিতীয় দৃশ্য : - 

[ গফুর অত্যন্ত চিন্তিত ; কপালে হাত। মাঝে মাঝেই মঞ্চের এদিক থেকে ওদিকে যাওয়া আসা করছে। যেন সে কিছু খুঁজছে। কিছুক্ষন পর আমিনা হন্তদন্ত হয়ে মঞ্চে প্রবেশ করলো। ]  

গফুর : কী হল মা , খোঁজ পেলি কিছু , মহেশের ? 

আমিনা : না বাবা , সব জায়গায় খুজলাম মহেশকে  ...................... কোথাও পেলাম না। 

গফুর : ( মাথায় হাত দিয়ে ) হায় রে  .................. মহেশটা যে কোথায় গেল  ...................... কাল থেকে কোনো খোঁজ নেই  ............... কোথায় যে গেল ! 

আমিনা : দাঁড়াও বাবা , আমি আরেক জায়গায় দেখে আসি। 

[ বলামাত্র আমিনা দ্রুত মঞ্চ থেকে প্রস্থান করলো। গফুর আবার ব্যাস্ত হয়ে অপেক্ষা করতে থাকল। কিছুক্ষন পর আমিনা আবার মঞ্চে প্রবেশ করলো। ]

আমিনা : ( হাঁফাতে হাঁফাতে ) বাবা  ........... খবর পেয়েছি বাবা , মহেশের খবর পেয়েছি। 

গফুর : ( ব্যস্ত হয়ে ) পেলি , খবর পেলি ? মহেশের খবর পেলি ? কোথায় ও বল বল  ............ 

আমিনা : মানিক ঘোষেরা আমাদের মহেশকে থানায় দিয়েছে। 

গফুর : দূর পাগলি ! থানায় কেন দেবে মহেশকে ! 

আমিনা : হ্যাঁ বাবা , সত্যি। ওদের চাকর বললে , তোর বাপকে বল গে যা , দরিয়াপুরের খোঁয়াড়ে খুঁজতে ! 


আমিনা : তাদের বাগানে ঢুকে গাছপালা নষ্ট করেছে মহেশ। 

গফুর : কিন্তু মানিক ঘোষ এ কাজ করতে পারলো ? গো - ব্রাহ্মনে ভক্তি তো তাঁর এ অঞ্চলে বিখ্যাত ! 

আমিনা : বেলা যে পড়ে এল বাবা , মহেশকে আনতে যাবে না ? 

গফুর : না। 

আমিনা : কিন্তু ওরা যে বললো , তিন দিন পার হলেই পুলিশের লোক মহেশকে গো হাটায় বেচে ফেলবে ? 

গফুর : বেচুক গে। 

তৃতীয় দৃশ্য : - 

[ গফুর বেশ খুশি ও নিশ্চিন্তমনে মঞ্চে বসে আছে। হঠাৎ আমিনা মঞ্চে প্রবেশ করলো। ]

আমিনা : বাবা  ............ বাবা  ............... ( হঠাৎ মঞ্চের একটি বিশেষ দিকে তাকিয়ে ) এ কী বাবা  .............. মহেশ তো চলে এসেছে  .................. তুমি ছাড়িয়ে আনলে  .................... যাক বাবা , ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এল।  

[ কিছুক্ষন পর গফুরের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে একজন মুসলিম ব্যক্তি মঞ্চে প্রবেশ করলেন ] 

জনৈক মুসলিম ব্যক্তি : এই যে গফুর , বলি , বায়না তো আগেই করা ছিল ; এবার নাও বাকী টাকাটা নাও ; এবার আমরা ওই বুড়ো ষাঁড়টাকে নিয়ে যাই। 

[ জনৈক মুসলিম ব্যক্তি টাকা দেওয়ার জন্য হাত বাড়ালো। গফুর ইতস্ততঃ করে হাত বাড়ালো। টাকাটা নিল। ] 

জনৈক মুসলিম ব্যক্তি : সওদাটা কিন্তু ভালোই পেলে গফুর  ................. না হলে অমন বুড়ো গরুর কি অমন দাম পাওয়া যায় ? 

[ এই বলে জনৈক ব্যক্তি যখনই পেছনে ঘুরে দু'পা এগিয়েছে , হঠাৎ গফুর যেন তার সম্বিৎ ফিরে পেল। ]

গফুর : দাঁড়াও মিঞা। 

জনৈক ব্যক্তি : ( গফুরের দিকে ফিরে ) কী হল গফুর ! 

গফুর : এই নাও তোমার টাকা। আমার মহেশকে আমি বেচবো না। 

জনৈক ব্যক্তি : কেন ? 



গফুর : কেন আবার কী ? আমার জিনিস আমি বেচবো না  ............... আমার খুশি। 

[ এই বলে গফুর টাকাটা ছুঁড়ে ফেলে দিল সেই ব্যক্তির মুখের ওপর। ] 

জনৈক ব্যক্তি : কাল তাহলে বায়না নিয়ে এলে যে ? 

গফুর : দিলাম তো তোমার বায়না ফিরিয়ে। 

জনৈক ব্যক্তি : ( কুটিল হাসি হেসে ) ও আচ্ছা  ................. বুঝেছি  ................ চাপ দিয়ে আরো দুটো টাকা বেশি নেবে তাই তো ?   .............. ঠিক আছে , এই নাও আরো দুটাকা। 

গফুর : না। 

জনৈক ব্যক্তি : কিন্তু এর বেশি কেউ একটা আধলা দেবে না , জানো তো ? 

গফুর : না  ....................

জনৈক ব্যক্তি : ( বিরক্ত হয়ে ) না তো কি ? চামড়াটাই যা দামে বিকোবে , নইলে মাল আর আছে কী ? 

গফুর : তোবা ! তোবা ! ........................ ( প্রচন্ড রেগে গিয়ে ) দেখ বুড়ো , তোমরা এই মুহূর্তে এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাও। নাহলে জমিদারের লোক ডেকে জুতোপেটা করে গ্রাম থেকে তাড়াবো। 

[ জনৈক মুসলিম ব্যক্তিটি কিন্তু কিন্তু করে মঞ্চ থেকে প্রস্থান করল। ] 

চতুর্থ দৃশ্য :- 

[ জমিদারের বৈঠকখানা। জনাদশেক মানুষের উপস্থিতি। সকলেই নির্দিষ্ট আসনে উপবিষ্ট। দুজন লেঠেল অবশ্য নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকবে। জমিদার শিবুবাবু একটি বিশেষ আসনে উপবিষ্ট। গফুর তাঁর সামনে অধোবদনে দন্ডায়মান। ] 

শিবুবাবু : ( চোখ রাঙিয়ে ) গফরা , তোকে যে আমি কী সাজা দেব , ভেবে পাই নে। কোথায় বাস করিস তা জানিস ? 

গফুর : ( হাত জোড় করে ) জানি হুজুর , আমরা খেতে পাইনে। নইলে আজ আপনি যা জরিমানা করতেন - আমি না করতাম না। 

[ সকলের অবাক হওয়ার ভঙ্গি। ] 

গফুর : ( কাঁদো - কাঁদো ভাব ) এমন কাজ আর কখনো করবো না কর্ত্তা ! ( নাক খত দেওয়ার ভঙ্গি করে ) এই নাক খত দিলাম। 

শিবুবাবু : ( নরম গলায় ) আচ্ছা , যা যা হয়েছে। আর কখনো এসব মতি বুদ্ধি করিস নে। 


[ গফুর নিজের বাড়িতে। ] 

গফুর : ( মঞ্চে প্রবেশ করতে করতে ) আমিনা  ............. আমিনা  ............ ভাত হয়েছে রে ? 

[ আমিনা মঞ্চের অন্যদিক থেকে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ; নিরুত্তর ] 

গফুর : ( চেঁচিয়ে ) কী হল ! হয়েছে ভাত ? 

আমিনা : না। 

গফুর : কী বললি  ...............  হয়নি ? ............. কেন শুনি ? 

আমিনা : চাল নেই বাবা। 

গফুর : ( রেগে গিয়ে ) চাল নেই ! সকালে আমাকে বলিস নি কেন ? 

আমিনা : আমি তোমাকে রাত্তিরে যে বলেছিলাম ! 

গফুর : ( ব্যাঙ্গ করে ) রাত্তিরে যে বলেছিলাম !  ............... রাত্তিরে বললে কারো মনে থাকে ?  ( মুখ বিকৃত করে ) চাল থাকবে কি করে ? রোগা বাপ খাক আর না খাক , বুড়ো মেয়ে চার - পাঁচবার করে ভাত গিলবি ! এবার থেকে চাল আমি কুলুপ বন্ধ করে বাইরে যাবো। দে  .................... এক ঘটি জল দে , তেষ্টায় বুক ফেটে গেল। বল তা'ও নেই ! 

[ আমিনা অধোমুখে যেমন দাঁড়িয়ে ছিল , তেমনই নিরুত্তর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এভাবে নিরুত্তর থাকা আমিনাকে দেখে গফুর প্রথমে খুব অবাক হয় , তারপর প্রচন্ড রেগে গিয়ে আত্মসংবরণ করতে না পেরে দ্রুতপদে আমিনার কাছে এসে তাকে সশব্দে এক চড় বসিয়ে দেয়। ] 

গফুর : মুখপোড়া হারামজাদা মেয়ে , সারাদিন তুই করিস কী ? এত লোকে মরে , তুই মরিস না ! 

[ আমিনা এবারও কোনো কথা বললো না। সামনে পড়ে থাকা মাটির কলসিটি নিয়ে চোখ মুছতে মুছতে মঞ্চ ত্যাগ করলো। আমিনার চলে যাওয়ার পর গফুর কেঁদে উঠলো। ] 

গফুর : হে ভগবান  ............... এ আমি কী করলাম ! খেতে না পাওয়া মেয়েটার গায়ে হাত তুললাম ! ................. কোথায় পাবে ও চার - পাঁচবেলা পেট ভরে ভাত ! কোথায় পাবে জল ! ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে মানুষের হাতে পায়ে ধরে একটু জল পায় ও।  তা'ও হয়ত আজকে পায়নি। কি বলতে কি বলে ফেললাম ! 

[ ঠিক এমন সময় জমিদারের পেয়াদা এসে মঞ্চে প্রবেশ করলো। ]

জমিদারের পেয়াদা : ( চিৎকার করে ) গফরা , এই গফরা  ........... ঘরে আছিস ? 

গফুর : ( তিক্তকণ্ঠে ) কেন ? 

জমিদারের পেয়াদা : বাবুমশাই ডাকচেন , আয়। 

গফুর : আমার খাওয়া - দাওয়া হয়নি , পরে যাবো। 

জমিদারের পেয়াদা : ( অত্যন্ত ক্ষুব্ধ স্বরে ) বাবুর হুকুম জুতো মারতে মারতে টেনে নিয়ে যেতে। 

গফুর : ( আরো রেগে গিয়ে ) মহারাণীর রাজত্বে কেউ গোলাম নয়। খাজনা দিয়ে বাস করি। আমি যাবো না। 

[ জমিদারের পেয়াদা এবার অগ্নিমূর্তি ধারণ করলো। গফুরের চুলের মুঠি ধরে মারতে মারতে তাকে নিয়ে মঞ্চ থেকে প্রস্থান করলো। ] 


ষষ্ঠ দৃশ্য :- 

[ গফুর মঞ্চে একা বসে আছে। অসহায় ও ক্ষুব্ধ। ]

গফুর : সারাজীবন ধরে গরীব হওয়ার দাম চুকিয়ে আসলাম  ................ সারাজীবন ধরে মেয়েটাকে খেতে দিতে পারলাম না। .................... শুধু লাঞ্ছনা আর অত্যাচার। .............. 

[ হঠাৎ নেপথ্যে আমিনার তীব্র চিৎকার শুনতে পাওয়া গেল। সঙ্গে একটা শব্দ। গফুর সেই চিৎকার শুনে অত্যন্ত সচকিত হয়ে দৌড়ে মঞ্চ ত্যাগ করলো। ] 

গফুর : ( নেপথ্য থেকে ) একী  ............. আমিনা  ............ মা  ........... পড়ে গেলি কী করে তুই ? ............... আর জলের কলসীটা ভেঙে গেল কীকরে ? 

আমিনা : ( নেপথ্য থেকে ) বাবা , মহেশ জল খেতে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে দিল। 

গফুর : ( নেপথ্য থেকে ) মহেশ  ....................... তোকে আমি আজ আর ছাড়বো না। আমার না খেতে পাওয়া মেয়েটার কষ্ট করে আনা জল তুই নষ্ট করলি ! ............. দাঁড়া  ...........

আমিনা : ( নেপথ্য থেকে ) না বাবা , একী করছো তুমি ! ....................... ছেড়ে দাও মহেশকে ! 

গফুর : ( নেপথ্য থেকে ) ওকে আমি আজ কিছুতেই ছাড়বো না। 

আমিনা : ( নেপথ্য থেকে ) না  ........... বাবা  ................ না ....... না .........     

[ নেপথ্য আবার একটি শব্দ। আমিনা ধীরে ধীরে মঞ্চে প্রবেশ করলো। তার পেছনে গফুর। হাতে একটা লাঙলের ফলা। ] 

আমিনা : ( কেঁদে উঠে ) এ কী করলে বাবা , আমাদের মহেশ যে মরে গেল। 

[ গফুর নিরুত্তর থেকে হাতের লাঙলটির দিকে তাকালো ; আমিনা তখনও কাঁদছে। ] 

গফুর : আমিনা , চল আমরা যাই  ............... 

আমিনা : ( অবাক হয়ে ) কোথায় বাবা ? 

গফুর : ফুলবেড়ের চটকলে , কাজ করতে। 

আমিনা : কিন্তু এই বাড়ি ঘর  ............... ! 

গফুর : ওসব থাক মা , মহেশের প্রায়শ্চিত্য হবে। দেরি করিস নে মা , চল অনেক পথ হাঁটতে হবে। 

[ কিছুক্ষন নিস্তব্ধতা। তারপর গফুর আকাশের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরকে যেন কিছু বলছে , এমন ভঙ্গি করে ] 

গফুর : আল্লা ! আমাকে যত খুশি সাজা দিও , কিন্তু আমার মহেশ তেষ্টা নিয়ে মরেচে। তার চরে খাবার এতটুকু জমি কেউ রাখেনি। যে তোমার দেওয়া মাঠের ঘাস , তোমার দেওয়া তেষ্টার জল তাকে খেতে দেয় নি , তার কসুর তুমি যেন কখনো মাপ কোরোনা। 

[ যবনিকা পতন। ]  






 

মহেশ গল্পের নাট্যরূপ .




  

You May Also Like

0 comments