জ্ঞানচক্ষু গল্পের সম্প্রসারণ। উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রকল্প।
জ্ঞানচক্ষু গল্পের সম্প্রসারণ।
জ্ঞানচক্ষু গল্পের পরিবর্ধিত রূপ।
বাংলা প্রকল্প।
উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রকল্প।
গল্পের নাম : এক্কেবারে নিজের গল্প
মূলগল্প : জ্ঞানচক্ষু
মূল গল্পের লেখিকা : আশাপূর্ণা দেবী।
[ আশাপূর্ণা দেবীর জ্ঞানচক্ষু গল্পটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে গল্পটিকে বর্ধিত রূপ দেওয়া হয়েছে। জ্ঞানচক্ষু গল্পের চরিত্রগুলিকে ও ঘটনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়কে '' এক্কেবারে নিজের গল্প '' - তে অনুসরণ করা হয়েছে। ]
এক্কেবারে নিজের গল্প
প্রথমবারের গল্প লেখার তিক্ত অভিজ্ঞতা তপনকে অত্যন্ত মর্মাহত করেছিল। গল্প লেখার এবং গল্প ছাপাবার ব্যাপারে তপন যে অন্য কারো সাহায্য নেবে না - এ সিদ্ধান্ত তো তপন আগেই নিয়েছিল। কিন্তু নতুন করে গল্প লেখার জন্য স্বাভাবিক মনোনিবেশ করতে পারছিলনা। চেষ্টা যে সে করেনি - তা নয়। টেবিলের উপর খাতা রেখে , কলমের খাপ খুলে তপন অনেকবার তৈরী হয়েছে। হাবিজাবি কিছু লিখে বারবার কেটে দিয়েছে। ব্যাস ঐটুকুই ; এরপর আর বেশিকিছু করা সম্ভব হয়নি তপনের। লিখতে চেয়েছে বারবার ; কিন্তু লেখার মত কিছু লিখে উঠতে পারেনি।
তপনের মনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া এই তীব্র ঝড়ের আভাস কিন্তু তার বাড়ির কেউ টের পায়নি ; মা , বাবা , কাকা কেউ না। বরং সকলে তো এই ভাবনাতেই অস্থির ছিল যে প্রথম গল্প ছাপবার পর তপন আরো বেশি করে গল্প লেখায় মনোনিবেশ করবে ; পড়াশোনা মাথায় উঠবে। এই নিয়ে মা বেশ চিন্তিত ছিলেন। কিন্তু সকলে এটা দেখে খুব অবাক হয় যে তপন দিনরাত গল্প লিখে বাড়ি মাথায় তুলছে না - সে দিব্যি স্বাভাবিক আছে ; স্কুলে যাওয়ার সময় স্কুলে যাচ্ছে ; পড়ার সময় পড়তে বসছে ; খাওয়ার সময় খাচ্ছে। কিন্তু গল্প লেখার জন্য তপনের মধ্যে যে তীব্র ব্যস্ততা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা সকলে করেছিল - সেরকম তো কিছু ঘটছে না ! তাহলে কী সত্যিই সে লেখক হয়ে উঠলো ! প্রতিষ্ঠিত নামকরা লেখকদের মত। এই তো তপনের নতুন মেসোমশাই - কলেজে পড়ান , আড্ডা দেন , সিনেমা দেখতে যান , শ্বশুরবাড়ি আসেন। সব কাজই তো করে চলেছেন ঠিকঠাক। তপনও কি তাহলে তার নতুন মেসোর মত লেখক হয়ে উঠলো !
তবে কেউ বুঝতে না পারলেও তপনের মনের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়টা প্রথম টের পান তপনের মা। বেশ কয়েকদিন হল তিনি লক্ষ্য করেছেন , তপন পড়তে বসছে - কিন্তু পড়ায় মন নেই ; তপন খেতে বসছে - কিন্তু খাওয়ায় আগ্রহ নেই।
-- '' এর তোর কী হয়েছে রে ; দিনরাত কেমন যেন আনমনা , কোনকিছুতেই মন নেই। ''
যেন সম্বিৎ ফিরে তপনের - '' কই , কিছু হয়নি তো। ''
-- '' না কি গল্পের জন্য নতুন কোনো প্লট খুঁজে পাচ্ছিস না ? '' মায়ের মুখে মাতৃসুলভ দুষটুমি ভরা হাসির ঝিলিক। কিন্তু কথাটা শুনে খুব রাগ হয় তপনের। কিছু বলে না সে।
মা যেন সকল সমস্যার মূল উৎসে পৌঁছে গেছেন এমন একটা ভাব এনে বলেন - '' আচ্ছা , আচ্ছা , বুঝেছি এবার। তোকে একটা সুখবর দিই - সামনে রোববার তোর ছোট মাসি আর নতুন মাসি এবাড়িতে বেড়াতে আসছে ; তা মেসোর কাছ থেকে ভালো একটা প্লট জেনে নিলেই তো হল। ''
তপন মুখ বুজে পড়ার টেবিল থেকে উঠে যায়। একথার পর হাসবার বা কাঁদবার - কোনোটারই ইচ্ছা তপনের ছিলনা।
সেদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতেই বাবা বললেন - '' তপন তোমার চিঠি এসেছে , তোমার পড়ার টেবিলে রাখা আছে। ............... আর হ্যাঁ , তোমার মা বাড়ি নেই। ফিরতে দেরি হবে ; রান্নাঘরে তোমার খাবার ঢাকা দিয়ে গেছেন , খেয়ে নিও। ''
বাবা বাড়ির অন্যদের তুলনায় একটু রাশভারি ; তিনি তপনের কোনো ব্যাপারেই বিশেষ হস্তক্ষেপ করেন না। মা'ও বাড়ি নেই। তাই চিঠিটা যে কেউ পড়েনি - সে ব্যাপারে তপন নিশ্চিত হল। কিন্ত তপনকে আবার চিঠি লিখলো কে ? প্রশ্নটা ঘুরপাক খেতে থাকে তপনের মনে। তাড়াতাড়ি পড়ার টেবিলে গিয়ে হাজির হয় সে। মনের চাপা উত্তেজনা তাকে হাত - ধুয়ে খাবার খেতে অনুপ্রাণিত করেনি। পড়ার টেবিলের কাছে গিয়েই তপন হামলে পড়ে চিটিটার উপর। একটা পোস্টকার্ড। '' ধ্রুবতারা '' মাসিক পত্রিকার পক্ষ থেকে এসেছে। মাত্র দুটি লাইন তাতে লেখা। কাঁপা কাঁপা হাতে ওই দুটি লাইনকেই বারবার পড়তে থাকে তপন -
'' দুঃখিত। আপনার লেখা আমাদের পত্রিকায় ছাপাবার জন্য মনোনীত হয়নি। ''
গল্প যে একেবারেই লিখেনি তপন - এমনটা নয়। দুটো গল্প লিখেও ছিল সে। সেই দুটো গল্পকেই সে বাড়ির কাউকে না জানিয়ে ধ্রুবতারার অফিসে পোস্ট করেছিল। আজ ফল পেল হাতেনাতে। দুটি গল্পের একটাও মনোনীত হয়নি। কিন্তু আশ্চর্য যে চরম হতাশাবোধ তপনের মধ্যে হওয়া উচিত ছিল - তেমনটা তো হচ্ছেনা ! বরং একটা তীব্র জেদ তপনের মনে জন্ম নিয়েছে - যতই যাই হোক , গল্প ছাপবার ব্যাপারে আর কারো সাহায্য নেবেন তপন। নিজের লেখা গল্প কাউকে দিয়ে কারেকশন করাবে না সে। তাই ধ্রুবতারার অফিস থেকে তার দুটি গল্পেরই প্রত্যাখ্যাত হওয়ার চিঠি পেয়েও ভেঙে পড়েনি তপন।
দিন কয়েক পরের ঘটনা। স্কুলে ইংরেজির ক্লাস। প্রতুল স্যার ক্লাস নিচ্ছেন। আজ তিনি ইংরেজি পাঠ্যবই থেকে নতুন একটি গল্প পড়াতে শুরু করলেন - Liam O'Flaherty - র লেখা His First Flight গল্পটি। প্রথম দিকে তেমন আগ্রহ পায়নি তপন। কিন্তু ধীরে ধীরে গল্প এগোতে থাকে এবং গল্পটির প্রতি এক আশ্চর্য আকর্ষণ অনুভব করে তপন। একটি ছোট্ট পাখি , যে আগে কখনো উড়তে শেখেনি ; তার ভাই - বোনেরা সকলেই উড়তে শিখেছে এবং তার সামনে দিয়ে উড়ছে। পাখিটি উড়বার জন্য বারবার চেষ্টা করছে ; কিন্তু অত উঁচু পাহাড় থেকে ঝাঁপ দেওয়ার মত সাহস করে উঠতে পারছেনা। ক্ষুধায় , ক্লান্তিতে জর্জরিত পাখিটি। তার মা যখন একটুকরো খাবার নিয়ে এসেও তাকে না দিয়ে একটু দূর দিয়ে উড়তে শুরু করলো , তখন পাখিটি ক্ষুধার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে পাহাড় থেকে ঝাঁপ দেয় ; এবং এই ঝাঁপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে উড়তে শিখলো।
পড়ানো শেষ করে প্রতুল স্যার ছাত্রদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন - '' বল , এই গল্পটি থেকে তোমরা কী শিক্ষা পেলে ? '' সকলকে অবাক করে দিয়ে একমাত্র হাত তুললো তপন। প্রতুল স্যারও একটু অবাক হলেন ; তপন তো কোনোদিনই পড়া দেওয়ার জন্য এভাবে হাত তোলে না !
-- '' হ্যাঁ , বল তপন। ''
-- '' অনেক সময় কোনো কাজ করতে গিয়ে আমরা ভয় পাই , মনে আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকে। কিন্তু একবার যদি সমস্ত ভয়কে উপেক্ষা করে কাজ শুরু করে দেওয়া যায় , তাহলে আত্মবিশ্বাস নিজে নিজেই ফিরে আসে এবং আমরা কাজে সফল হই। ''
প্রতুল স্যার অবাক চোখে তপনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন , কিছু বললেন না। কিন্তু তপন জানতো এর চেয়ে ভালো উত্তর হয়তো আর কারো জানা নেই।
সেদিন থেকে এক আশ্চর্য পরিবর্তন এল তপনের মধ্যে। তপন এবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ - গল্প সে লিখবেই।
এর ঠিক ছয়মাস পর তপনের জীবনের সবচেয়ে প্রতীক্ষিত দিনটি এল। একদিন তপন মায়ের সাথে মামার বাড়ি বেড়াতে এসেছে। ছোট মাসি আর নতুন মেসোও এসেছে। নতুন মেসোর সঙ্গে বহুদিন পর তপনের দেখা। এর মধ্যে নতুন মেসো আর তপনের লেখার ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহ দেখান নি। কিন্তু দুপুরে খাওয়ার টেবিলে তপনকে দেখে কিছু একটা বলতে হয় - তাই ভেবে নতুন মেসো তপনকে বললেন -
-- '' তা তপন , আজকাল কি আর গল্প টল্প লিখছো না ; লিখলে আমায় দিয়ো , আমি কারেকশন করে ছাপিয়ে দেব ,আগের বারের মত। ''
তপন কোনো কথা বললো না ; একছুটে মায়ের ব্যাগ থেকে একটা পত্রিকা বের করে আনলো। বাংলার সবচেয়ে বিখ্যাত ও প্রচলিত ছোটদের পত্রিকা '' ধ্রুবতারা '' র একটি সংখ্যা। মেসোকে দিল। মেসো অবাক হয়ে পত্রিকাটি হাতে নিলেন ; পৃষ্ঠা উল্টে সূচিপত্রে চোখ রাখলেন। প্রথমেই দেওয়া আছে - '' আমার প্রথম গল্প লেখা ( গল্প ) - শ্রী তপন কুমার রায়। ''
এই গল্পটির ব্যাপারে তপন কাউকে কিছু বলেনি। এমনকি মাও কিছু জানতেন না। তাই খাবার টেবিলে তপনের গল্পের গল্পটি সকলকে অবাক করেছিল। সবচেয়ে অবাক হয়েছিলেন নতুন মেসো। তাঁর কারেকশন ছাড়া তপনের গল্প বিখ্যাত পত্রিকায় ছেপেছে - এ যেন তাঁর ধারণার বাইরে।
তপনের জীবনের সবচেয়ে সুখের দিনটি এল আজ। আজ সকলেই তপনের গল্প নিয়ে ব্যাস্ত। কেউ আর নতুন মেসোর কারেকশন নিয়ে কিছু বলছে না। এ গল্পের প্রতিটি লাইন তপনের। নতুনমেসোর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না যে তিনি আনন্দ পেয়েছেন ; না কি অন্য কিছু ! একমাত্র মা 'ই মনে হয় তপনের মনের আসল কষ্টের জায়গাটা ধরতে পেরেছিলেন। তিনি মুচকি মুচকি হাসছেন। আজ সত্যিই নিজেকে লেখক মনে হচ্ছে তপনের।
0 comments