চন্দ্রনাথ গল্পের সম্প্রসারণ। উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রকল্প।
চন্দ্রনাথ গল্পের সম্প্রসারণ।
চন্দ্রনাথ গল্পের পরিবর্ধিত রূপ।
বাংলা প্রকল্প।
উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রকল্প।
গল্পের নাম : চন্দ্রনাথের প্রত্যাবর্তন।
মূলগল্প : চন্দ্রনাথ।
মূল গল্পের লেখক : তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়।
[ তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের চন্দ্রনাথ গল্পটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে গল্পটিকে বর্ধিত রূপ দেওয়া হয়েছে। চন্দ্রনাথ গল্পের চরিত্রগুলিকে ও ঘটনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়কে '' চন্দ্রনাথের প্রত্যাবর্তন '' - গল্পতে অনুসরণ করা হয়েছে। ]
চন্দ্রনাথের প্রত্যাবর্তন।
চন্দ্রনাথ বরাবরই সাধারণ ও স্বাভাবিক বোধগম্যতার বাইরে বিরাজ করত - তার পরিচয় আমরা আগেই পেয়েছি। চন্দ্রনাথের মতে , তাঁকে অন্যায়ভাবে পরীক্ষায় সেকেন্ড করানো হয়েছে। সে আসলে ফার্স্ট হওয়ার যোগ্য। তাই দ্বিতীয় পুরস্কার গ্রহণ করাকে '' বিনিথ মাই ডিগনিটি '' বলে মনে করেছিল। চন্দ্রনাথের মতে হারু স্কুলের সেক্রেটারির ভাইপো হওয়ার সুবাদে আগে থেকেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র জানতে পেরেছিল। আর তাছাড়াও পরীক্ষার খাতা দেখার সময় কিছু শিক্ষক হারুর প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্ব করেছেন। তা'ও অঙ্ক পরীক্ষার দিন হারু চন্দ্রনাথের খাতা দেখে অঙ্ক টুকেছিল।
তবে , ম্যাট্রিক পরীক্ষার রেজাল্টের ব্যাপারে চন্দ্রনাথ যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল তার অনেকটা মিলে গেলেও একটা বিষয় মেলেনি - হারু ম্যাট্রিক পরীক্ষায় চন্দ্রনাথকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে। হারু খুব ভালো ফল করায় তার কাকা , স্কুলের সেক্রেটারি এক বিরাট ভোজসভার আয়োজন করেছিলেন। চন্দ্রনাথ এই ভোজসভায় আমন্ত্রিত হলেও সে তো উপস্থিত হয়ই নি , বরং চিঠি লিখে সে এই ভোজসভার বিরূপ প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করে। ঠিক সেই ভোজসভার দিনই চন্দ্রনাথ যেন কোন জনহীন ছায়াপথে , সুদূর জ্যোতিস্কলোকের উদ্দেশ্যে হারিয়ে যায়। কোনো পিছুটান তার ছিলনা। স্কুলের সঙ্গে সম্পর্ক সে ছিন্ন করেছিল ; নিজ দাদা নিশানাথবাবুর সঙ্গে তো সম্পর্ক অনেক আগেই ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
এরপর কালপ্রবাহে বয়ে গেছে অনেক জল। সময় পেরিয়ে গেছে অনেকটা। প্রায় কুড়ি বছর - সময়টা কম নয়। যথারীতি চন্দ্রনাথের কোনো খোঁজ আজ অবধি আমি পাইনি। হারুর কাকা হারুকে আই সি এস তৈরী করতে চেয়েছিলেন। হারু তাই হয়েছে। আজ সে পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলের একটি জেলার কালেক্টর। প্রশাসক হিসাবে সে খুব সফল। সরকারি উপরতলায় তার যথেষ্ট প্রভাব - প্রতিপত্তি। আর আমি সেই একই থেকে গেছি। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য চর্চায় হাত পাকিয়েছিলাম। কলেজ পাশ করার পর লেখালিখিটাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিলাম। এখন আমি মোটামুটি নামকরা একজন সাহিত্যিক এবং তার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্রের রাজনৈতিক সাংবাদিক। মোটামুটি সফল বলা যেতে পারে। বলা বাহুল্য , পেশার কারণে হারুর সঙ্গে এখনো আমার যোগাযোগ আছে।
চন্দ্রনাথের কথা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেলেও প্রবল প্রতাপশালী কালচক্র আমাদের তিনজনকে ; অর্থাৎ আমি , হারু ও চন্দ্রনাথকে আবার একসাথে মিলিয়ে দেয়। তবে , সেই স্কুল জীবনের মতই এই মিলন ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতার। ঘটনার শুরু হয়েছিল মাস তিনেক আগে। পশ্চিমের দুটি জেলায় রাজ্য সরকার একটি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কিন্তু এই বাঁধ নির্মিত হলে বৃহত্তর অর্থে কিছু লাভ হলেও সেই বাঁধ নির্মাণের ফলে দুটি জেলার প্রায় পাঁচশো গ্রাম জলমগ্ন হয়ে পড়বে ; বাসস্থান , কৃষিজমি - সবকিছুই জলের অতলে তলিয়ে যাবে। তাই এই দুই জেলার লক্ষাধিক মানুষ একজোট হয়েছে সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই আন্দোলন হিংসাত্মক আকার ধারণ করছে। তাই সারা রাজ্য এবং পুরো দেশের কৌতুহলের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে এই ঘটনা।
ঘটনাচক্রে , হারু বিশেষ প্রমোশন পেয়ে পশ্চিমাঞ্চলের বিশেষ পরিদর্শক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছে এবং আমি পত্রিকার পক্ষ থেকে প্রেরিত একজন সাংবাদিক। সরকার বিরোধী আন্দোলন এখন তীব্র আকার ধারণ করেছে। আরো লক্ষ লক্ষ মানুষ আন্দোলনে যোগদান করে আন্দোলনকে তীব্রভাবে শক্তিশালী করে তুলেছে। সরকারের শীর্ষ দপ্তর থেকে হারুকে পাঠানো হয়েছে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত সমস্যা সমাধানের জন্য। হারুর নেতৃত্বে একের পর এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু প্রতিটি বৈঠকের ব্যর্থতার সঙ্গে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে ওঠে। সরকার বলপ্রয়োগের পক্ষপাতী নয় ; তাই সরকার সর্বতোভাবে চেষ্টা করছে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার। কিন্তু সেভাবে কোনো সুরাহার পথ বেরিয়ে আসছে না। বিষয়টি পাঁচশো গ্রামের লক্ষাধিক মানুষের বাসস্থান ও রুজির সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই আন্দোলনকারীরা কোনোরকম আপোসের পথে হাঁটতে নারাজ।
আজ আন্দোলনকারীদের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে রাজ্য সরকারের বৈঠক। এই বৈঠকের উপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে। এই বৈঠকে সরকারের প্রতিনিধিত্ব করছে হারু এবং আমি নিউজ কভারের দায়িত্বে।
চমকটা লাগলো আন্দোলনকারীদের শীর্ষ নেতৃত্ব প্রশাসনিক ভবনে পৌঁছনোর পর। শীর্ষ নেতৃত্বের গাড়ি প্রশাসনিক ভবনে এসে পৌঁছনোর পর জনাদশেক সাংবাদিক শীর্ষ নেতৃত্বকে ঘিরে ধরলেন ; আমিও ছিলাম তাদের দলে। না , চিনতে ভুল হয়নি এতটুকুও। কুড়ি বছর পরেও চেহারার সামান্য পরিবর্তন এলেও চন্দ্রনাথ প্রায় একই রকম আছে। তার সেই রৌদ্রতেজদীপ্ত ধারালো চোখের দৃষ্টি , হার না মানা ব্যক্তিত্ব , ব্যতিক্রমী চরিত্র - সবই যেন একই রকম আছে - চন্দ্রনাথ যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিল - সেই কথোপকথন থেকে আমি তা বুঝতে পেরেছিলাম। আমি অবাক বিহ্বল হয়ে গিয়ে তাকে কোনো প্রশ্ন করতেই ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এই যে চন্দ্রনাথ আমাকে দেখেছে , লক্ষ্য করেছে এবং চিনতেও পেরেছে বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু তাতে তার অভিব্যক্তিতে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না।
বৈঠক শুরু হতেই হারু চন্দ্রনাথকে দেখে উচ্ছসিত হয়ে ওঠে - '' এই চন্দ্রনাথ , কীরে চিনতে পারছিস ? '' দ্বিধাহীন শীতল কণ্ঠে চন্দ্রনাথ বলে ওঠে - '' ভুলে যাওয়ার মত কোনো কারণ নেই। কিন্তু এটা আমাদের ব্যক্তিগত আলাপচারিতার জায়গা নয়। জনগণের স্বার্থে আজ আমি তাদের প্রতিনিধি। সুতরাং কাজের কথায় আসা যাক। ''
চন্দ্রনাথের এই উত্তরে হারু যেন একটু দমে যায়। আমি খুব অবাক হই। এত বছর পর পুরোনো মানুষদের সঙ্গে দেখা হয়েও তার মধ্যে কোনো উচ্ছাস নেই। এমনই নির্লিপ্ত সে।
যাই হোক , '' কাজের কথা '' শুরু হওয়ার পর প্রথমেই চন্দ্রনাথ প্রায় আধ ঘন্টা ধরে সরকারের প্রকল্পের ফলে কীভাবে পাঁচশো গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হবেন - তার বর্ণনা শুনতে পাওয়া গেল এবং হারু চন্দ্রনাথের অকাট্য যুক্তির সামনে একপ্রকার চুপ করেই থাকল। শেষে চন্দ্রনাথ এও জানিয়ে রাখলো - বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে যে মামলা শুরু হয়েছিল - তার শুনানি শেষ হয়েছে। আগামী দুই - এক দিনের মধ্যে রায় বেরোবে। তাই বিচারাধীন বিষয়টি নিয়ে আপাততঃ কোনো বৈঠক বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন নেই।
নমস্কার জানিয়ে চন্দ্রনাথ চলে যেতেই হারু আর আমি পরস্পরের দিকে মুখ চাওয়া - চাওয়ি করলাম। বলা বাহুল্য , দুজনেই ঐসময় চন্দ্রনাথের কথাই ভাবছিলাম। ছেলেটি চিরকালই এইরকম অপ্রতিরোধ্য। কথা বলার সময় তার কপালে ফুলে ওঠা শিরার লাল ত্রিশুল চিহ্ন লক্ষ্য করেছিলাম। অর্থাৎ চন্দ্রনাথ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কাউকেই সে জিততে দেবেনা। হারু বলে উঠলো - '' একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিস নরু ? "
- '' কী ? "
- '' চন্দ্রনাথের কাছে আমরা সবাই কেমন যেন ছোট , হেরে যাওয়া। আমি এত উঁচু পদে বসে থাকা একজন সিভিল সার্ভেন্ট ; অথচ চন্দ্রনাথ যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল আমরা কতটা ভুল। ওর বজ্র কঠিন চোয়াল দেখে মনে হচ্ছিল লক্ষ লক্ষ মানুষের সমর্থন ওর সঙ্গে না থাকলেও ওর অবস্থান একই থাকতো। ''
আমি হারুকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম - '' দেখ হারু , ব্যাপারটা সেরকম নয়। তুই একটা দায়িত্বপূর্ণ পদে আছিস। সরকার কর্তৃক আরোপিত দায়িত্ব এবং জনগণের স্বাৰ্থ - দুইই তোকে দেখতে হয়। তাই তোর নিজেকে হেরে যাওয়া মনে করার কোনো কারণ নেই। ''
বলা বাহুল্য আমার কথা হারুকে সন্তুষ্ট করতে পারলো বলে মনে হল না। আমিও মনে মনে জানি - আকাশের সেই ধ্রুবতারার মত চন্দ্রনাথ আজ অনেক উপরে ; হয়তো সবসময়ই সে উপরেই ছিল - আমরাই তাকে বুঝতে ভুল করেছি। কেমন একটা বিশ্বাসও আমার মনে জন্মেছিল - চন্দ্রনাথের নেতৃত্বে যে আন্দোলন চলছে - তার জয় হবেই। চন্দ্রনাথ হেরে যাওয়ার পাত্র নয়। এত জনপ্রিয়তা , মানুষের সমর্থন পেয়েও তার পোষাক সাধারণ , চলন সাধারণ ; কিন্তু লড়াইয়ের মানসিকতা বাঘের সঙ্গে তুলনীয়।
ঠিক এর দিন দুই পর কোর্টের রায় বেড়িয়েছে। কোর্টের রায় যথারীতি আন্দোলনকারীদের পক্ষে। শুরু হয়েছে তাদের বাঁধভাঙা উচ্ছাস। আমি সাংবাদিক ; অনেক গোপন খবর আমাকে রাখতে হয়। খবর নিয়ে জেনেছি যে , এই বাঁধভাঙা উচ্ছাসে চন্দ্রনাথ কোথাও নেই। সে আজ বিকেলেই রওনা হচ্ছে অন্য একটি রাজ্যে অপর কোনো এক সমস্যার সম্মুখীন হতে। তাই বিকেলের আগেই আমি আর হারু চন্দ্রনাথের ডেরায় হানা দিলাম।
একটি ছোট্ট একচালা কুঁড়ে ঘর। দেখে অবাক হয়ে গেলাম এই বিরাট আন্দোলনের শীর্ষ নেতা এই কুঁড়েঘরে থাকে ! বাইরে থেকে নাম ধরে ডাকতেই চন্দ্রনাথ বেরিয়ে এল। মুখে সেই নির্লিপ্ত হাসি। হারুই প্রথম কথা বললো -
- '' তোর জয়ের জন্য অভিনন্দন। কিন্তু এই আনন্দের মুহূর্তে তুই নেই কেন ? ''
চন্দ্রনাথ দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিল - '' জয়টা প্রাসঙ্গিক ; কিন্তু তার জন্য উৎসব অর্থহীন। ঠিক যেভাবে তোর স্কলারশিপ পাওয়ার ভোজটা আমার কাছে অর্থহীন বলে মনে হয়েছিল। ''
আজ অনেকদিন পর আমি আবার স্মৃতির অন্ধকারে ডুব দিয়েছি। চোখ বন্ধ করলেই ফুটে ওঠে সেই বোর্ডিং স্কুল , চন্দ্রনাথ , হারু , আমি হেড মাস্টারমশাই। মনকে প্রবলভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছে চন্দ্রনাথের প্রবল ব্যক্তিত্ব। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেই যেন বলে উঠলাম - '' নাহঃ , চন্দ্রনাথকে আমরা আজও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। ''
0 comments