বহুরূপী গল্পের সম্প্রসারণ। উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রকল্প।
বহুরূপী গল্পের সম্প্রসারণ।
বহুরূপী গল্পের পরিবর্ধিত রূপ।
বাংলা প্রকল্প।
উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রকল্প।
গল্পের নাম : অ্যাডভেঞ্চার ও হরিদা।
মূলগল্প : বহুরূপী।
মূল গল্পের লেখক : সুবোধ ঘোষ।
[ সুবোধ ঘোষের বহুরূপী গল্পটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে গল্পটিকে বর্ধিত রূপ দেওয়া হয়েছে। বহুরূপী গল্পের চরিত্রগুলিকে ও ঘটনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়কে '' অ্যাডভেঞ্চার ও হরিদা '' - গল্পতে অনুসরণ করা হয়েছে। ]
অ্যাডভেঞ্চার ও হরিদা।
জগদীশবাবুর বাড়িতে সেদিন সন্ধ্যাবেলায় অফুরন্ত উপার্জনের সুযোগ ছিল হরিদার। কিন্তু হরিদা সেই সুযোগ হরিদা হেলায় হারালেন। বহুরূপী সাজতে গিয়ে চরিত্রের একেবারে অন্দরমহলে ঢুকে যান তিনি। বিরাগীর চরিত্রে হরিদা সত্যিকারের বিরাগীর মতই সমস্ত পার্থিব লোভকে উপেক্ষা করেছেন। আমরা এনিয়ে কিছুটা রাগারাগি করলেও হরিদা আগের মতোই নির্লিপ্ত থাকলেন। এভাবেই দিন চলতে থাকলো। কখনো হরিদার ভাতের হাড়িতে চাল ফোটে , কখনো শুধুই জল ফোটে।
হরিদা বহুরূপী - সেকথা আমরা সকলেই জানি। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ হরিদাকে প্রকৃত শিল্পী বলে মনে করে। বহুরূপীর সাজ হরিদা খুব ভালোবাসেন। শুধু অর্থ উপার্জন করার থাকলে তো অনেকভাবেই করতে পারতেন হরিদা। কিন্তু যখন তিনি যে সাজে বহুরূপী সাজেন সেই রূপে তিনি যেন বিলীন হয়ে যান। সবই ঠিকঠাক চলছিল ; কিন্তু হরিদার জীবনের এই চরম আর্থিক দুরবস্থা আমাদের সকলকেই খুব ভাবিয়ে তোলে। কিন্তু আমাদের ঠিক যে কী করণীয় সেটা আমরা কেউই বুঝতে পারছিলাম না। তবে তার অর্থনৈতিক অবস্থা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছিল।
তবে এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো - চরম আর্থিক দুর্গতির মধ্যে থাকলেও হরিদা আমাদের কাছে থেকে কখনোই টাকা ধার চান নি। আমরা সকলেই মোটামুটি স্বচ্ছল। তবে আমরা কখনোই আগ বাড়িয়ে হরিদাকে সাহায্য করতে যাইনি - পাছে হরিদার আত্মসম্মানে আঘাত লাগে !
তবে এর ঠিক একমাস পর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। উল্কার গতিতে ছুটতে থাকা এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সবকিছুই গতিশীল , চলমান। কোনোকিছুই এক অবস্থায় চিরকাল বিরাজমান থাকতে পারেনা। তাই হরিদার জীবনও পাল্টে গেল।
একদিন পার্কের সামনে ট্রাফিক পুলিশ সেজে হরিদা গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছিল। যারা হরিদাকে চিনতে পেরেছিল তারা হরিদাকে দুটাকা - একটাকা দিয়ে হাসিমুখে চলে যায়। কেউ কেউ আবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হরিদার কীর্তিকলাপ দেখতে থাকে। ট্রাফিক পুলিশরূপী হরিদাকে দেখে তেমন একটা আনন্দ বা মনোরঞ্জনের উদ্রেক না হলেও প্রতিদিনের একঘেঁয়েমি থেকে মুক্তির একটা আহ্বান ছিল। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে থেকে একটি বছর বাইশের ছেলে হরিদাকে দশটাকার দশটি কয়েন দেয়। হরিদা হাত পেতে কয়েনগুলো নেয় ঠিকই ; কিন্তু সেদিকে খুব একটা মনোযোগ দেয় না। চট করে কয়েনগুলো পকেটস্থ করে। আবার হরিদা নাটকীয়ভাবে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে।
সেইদিন সন্ধ্যাবেলা হরিদার বাড়ি যেতেই হরিদাকে দেখলাম বেশ একটা খুশি খুশি ভাব। আমি জিজ্ঞেস করলাম - '' কী হয়েছে হরিদা , বেশ খুশি বলে মনে হচ্ছে ? ''
হরিদা ছোট্ট করে বলেন ,- '' আজ পকেট বেশ গরম। ''
- '' কেন কী হয়েছে হরিদা ? ''
- '' আজ দুপুরে ট্রাফিক পুলিশ সেজে পার্কের গেটের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। টুকটাক রোজগার হচ্ছিল ; হঠাৎ একটা ছেলে একটু বেশি খুশি হয়ে বেশ কয়েকটা দশ টাকার কয়েন দিয়ে গেল। ''
অনাদি প্রশ্ন করে - '' তা কত রোজগার হল ? ''
- '' গুনে তো দেখিনি , ওই পকেটের মধ্যে আছে এখনো। ''
ভবতোষ আর অনাদি হরিদার পুলিশ-প্যান্টের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমিও উৎসাহ নিয়ে দেখতে থাকলাম। দু - এক টাকার কয়েনের সংখ্যায় বেশি। তবে কয়েকটা দশ টাকা - পাঁচ টাকার কয়েনও আছে। তবে সবচেয়ে আশ্চর্য করার মত ব্যাপার হল দশটি দশ টাকার কয়েন। অনাদি হরিদার সমস্ত রোজগার থেকে দশ টাকার কয়েনগুলিকে আলাদা করলো। অনাদির ভ্রু কুঁচকে আছে। ভবতোষও কেমন যেন চিন্তিত দৃষ্টিতে কয়েন গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েন গুলো দেখে আমারও কেমন যেন খটকা লাগলো।
অনাদি বললো - '' একটু বেশি চকচকে না ? এক্কেবারে নতুন ! ''
ভবতোষ বললো - '' সোনার মত উজ্জ্বল। .............. এক্কেবারে সোনা বলেই তো মনে হচ্ছে। ''
আমি বললাম - '' কয়েনের মধ্যেকার লেখা ও ছাপ সাধারণ কয়েনের মত নয়। ''
আমরা তিনজনই একমত হলাম যে , এ সাধারণ দশ টাকার কয়েন নয়। আমরা প্রত্যেকেই এর মধ্যে কোনো গন্ধ পেলাম। হরিদা বেশ ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে গেছে। কী করবে , কী বলবে বুঝতে পারছে না সে। আমরা ঠিক করলাম কাল সকালেই পুলিশ স্টেশন যেতে হবে এগুলো নিয়ে। হরিদাও এতে সম্মতি দিল। তাঁর মধ্যে এখন খুশি খুশি ভাবটা উধাও।
আমি বললাম - '' হরিদা , আজ রাতে তোমার কাছে এগুলো রাখা ঠিক হবে না। বিপদ হতে পারে। যে তোমাকে এগুলো গেছে সে নিশ্চই এগুলো উদ্ধার করতে আসবে। ''
অনাদি বললো , - '' তাহলে তো হরিদারও আজ রাতে বাড়িতে থাকা ঠিক নয় ; বিপদ তো হরিদারও হতে পারে। ''
তাই আমরা সবাই মিলে ঠিক করলাম , আজ রাতে হরিদা আমার বাড়িতে থাকবে এবং কাল সকাল হতেই আমরা সবাই পুলিশ স্টেশন যাবো।
সেইমত আমরা সকাল হতেই পুলিশ স্টেশনে পৌঁছলাম। থানার বড়বাবু হরিদাকে চিনতেন। তাই আমাদেরকে কোনো বিরূপ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হল না। হরিদার মুখ থেকে বড়বাবু সমস্তটাই শুনলেন , কয়েনগুলো দেখলেন এবং তারপর যা বললেন তাতে আমাদের সকলের চক্ষু চড়কগাছ। বড়বাবু বললেন , - '' এই প্রত্যেকটা কয়েন আসল চব্বিশ ক্যারাটের সোনা দিয়ে তৈরী। সাধারণের তুলনায় বেশি ভারী ; মোট ওজন প্রায় আড়াইশো গ্রাম এবং বাজার দর প্রায় দশ লক্ষ টাকা। কিছুদিন আগে উত্তরবঙ্গের এক পূর্বতন জমিদারবাড়িতে একটি সোনার বিগ্রহ চুরি হয়। পুলিশের উপরমহল সোর্স মারফত জানতে পারে , সেই বিগ্রহ গলিয়ে দশটি দশ টাকার কয়েনে পরিণত করা হয়। আমরা জানতে পারি চোর আমাদের থানা এলাকাতেই গা ঢাকা দিয়ে আছে। গতকাল দুপুরে এক সন্দেহজনক ব্যক্তিকে পার্কের পাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখে কর্তব্যরত পুলিশের সন্দেহ হয়। তাকে তাড়া করে ধরেও ফেলা হয়। কিন্তু তার কাছ থেকে কিছুই পাওয়া যায়নি। সম্ভবতঃ সেই সময়ই ওই চোর হরির হাতে কয়েনগুলি দিয়ে দিয়েছিল। ''
আমরা সকলেই চুপ। প্রচন্ড বিস্মিত। দুদিন পর বড়বাবু আবার আমাদের সকলকে পুলিশ স্টেশনে ডেকে পাঠালেন। আমরা গেলাম। বড়বাবু খুব খোশ মেজাজে ছিলেন। আমরা ঘরে ঢুকতেই বড়বাবু আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। তিনি বললেন - '' হরির জন্য দারুন একটা খবর আছে। আমরা পূর্ববঙ্গের সেই জমিদারবাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা বলেছেন তাঁরা সেই সোনা দিয়ে আবার একটি বিগ্রহ গড়িয়ে নেবেন। কিন্তু হরির জন্য ভালো খবর হল এই যে সেই জমিদার বাড়ি থেকে তোমাকে পুরস্কৃত করা হবে। এই পুরস্কারের অর্থমূল্য প্রায় তিন লক্ষ্য টাকা। এছাড়াও তাদের এখন জমিদারি না থাকলেও তাদের বিস্তর জমি জায়গা , দেখাশোনার জন্য লোক চাই। তারা সেই কাজে হরিকে নিযুক্ত করতে চান। ''
বড়বাবুর মুখে এই কথাগুলি শুনে আমিতো খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম। কিন্তু হরিদার মধ্যে তেমন কোনো পরিবর্তন চোখে পড়লো না। হরিদা বললেন - '' না বড়বাবু ; এতে আমার কোনো কৃতিত্ব নেই। তাই ওই পুরস্কারের যোগ্য প্রাপক আমি নই। এ আমি নিতে পারবো না বড়বাবু। আর তাছাড়া কোনো বাঁধাধরা কাজেও আমার কোনো উৎসাহ নেই। ''
এবার কিন্তু আমরা সক্রিয় হলাম। আমরা জোর করে হরিদাকে পুরস্কারের অর্থমূল্য গ্রহণ করতে বাধ্য করলাম। কিন্তু জমিদারি দেখাশোনার কাজে রাজি করাতে পারলাম না। যাক পুরস্কার লাভের ফলে হরিদার অর্থকষ্ট তো লাঘব হল ; আর তাছাড়া হরিদা আমাদের ছেড়ে দূরে কোনো জায়গায় চলে যান - এটাও আমরা মন থেকে চাইনি। তাই হরিদা থেকে গেলেন তাঁর সেই পুরোনো রূপের খেলা নিয়েই।
0 comments