উচ্চমাধ্যমিক প্রকল্প : কিশোর অপরাধ প্রবণতা :-
উচ্চমাধ্যমিক প্রকল্প : কিশোর অপরাধ প্রবণতা :-
উচ্চমাধ্যমিক সমাজতত্ত্ব প্রকল্প : কিশোর অপরাধ প্রবণতা।
কিশোর অপরাধ প্রবণতার কারণ। কিশোর অপরাধ প্রবণতার বৈশিষ্ট। কিশোর অপরাধ প্রবণতা প্রতিরোধে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ।
উচ্চমাধ্যমিক প্রকল্প : কিশোর অপরাধ প্রবণতা :-
ভূমিকা :-
বর্তমান ভারতে কিশোর অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির বিষয়টি উদ্বেগজনক। কিশোর অপরাধ প্রবণতার বিষয়টি শুধুমাত্র ভারতে নয় - সারা পৃথিবীতেই কিশোর অপরাধ প্রবণতার বিষয়টি উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। কিশোর অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির কারণগুলি মূলতঃ সামাজিক , অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক। শিশু ও কিশোরদের বিশেষ ধরণের সমস্যাগুলি তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি করে। এই ধরণের প্রবণতাকে শিশু ও কিশোর অপরাধ বা Juvenile Delinquency বলা হয়। ভারতীয় সংবিধান প্রদত্ত ব্যখ্যা অনুযায়ী , ৭ থেকে ১৮ বছরের নীচের শিশু ও কিশোরদের Juvenile Justice Act 1986 দ্বারা বিচার করা হয়। কিশোর অপরাধ সংক্রান্ত আদালতের একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক হিসাবে ডক্টর জে বি মুখোপাধ্যায় বলেছেন , কিশোরদের অপরাধমূলক ক্রিয়াকলাপ নির্ভর করে তাদের শ্রেণিগত জীবনযাত্রা ও সামাজিক পরিবেশের উপর। সমাজতাত্ত্বিক ও পশ্চিমবঙ্গ মহিলা কমিশনের প্রাক্তন সভানেত্রী ডক্টর বেলা দত্তগুপ্ত বলেছেন , কিশোর অপরাধ প্রবণতার প্রতিকারের যেকোনো প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে সামাজিক সচেতনতা ও সামাজিক শৃঙ্খলার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।
বর্তমান প্রকল্পটিতে শিশু ও কিশোর অপরাধ প্রবণতা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। কিশোর অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির বিভিন্ন কারণ , কিশোর অপরাধ প্রবণতা দূর করতে ও প্রতিরোধ করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ , কিশোর অপরাধ সংক্রান্ত সাংবিধানিক বিষয় , কিশোর অপরাধ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চালচিত্র , সমাজতত্ববিদদের অভিমত - ইত্যাদি বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে।
যেসকল উদ্দেশ্যগুলিকে সামনে রেখে প্রকল্পটি রচনা করা হয়েছে সেগুলি হল -
১. কিশোর অপরাধ প্রবণতা সম্পর্কে ধারণা গঠন।
২. কিশোর অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির কারণগুলি অনুসন্ধান করা।
৩. সামাজিক ও পরিকাঠামো সংক্রান্ত কারণগুলি ছাড়াও বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলিও কিশোর অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। সেই সকল মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা।
৪. কিশোর অপরাধ প্রবণতা প্রতিরোধ করতে যেসকল ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে - সে সম্পর্কে ধারণা গঠন।
৫. কিশোর অপরাধ প্রবণতা সম্পর্কে চিকিৎসক , মনস্তত্ত্ববিদ ও সমাজতত্ববিদদের মতামত বিশ্লেষণ করা।
৬. কিশোর অপরাধ প্রবণতা প্রতিরোধ করতে যেসকল প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে - সেগুলি কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে এবং তার বাস্তবতা সম্পর্কে আলোচনা করা।
৭. কিশোর অপরাধের বিভিন্ন বৈশিষ্টগুলির উপর আলোকপাত করা।
৮. আন্তর্জাতিক স্তরে কিশোর অপরাধ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে যেসকল গবেষণা ও পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে , সেগুলি তুলে ধরা।
৯. কিশোর অপরাধ সংক্রান্ত সাংবিধানিক বিষয়গুলি সম্পর্কে ধারণা গঠন করা।
১০. সর্বোপরি , বিষয়টি সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের কৌতূহলী করে তোলা।
প্রকল্পের গুরুত্ব :-
যেসকল কারণে প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতে পারে , সেগুলি হল -
১. প্রকল্পটির মাধ্যমে কিশোর অপরাধ সংক্রান্ত বিষয়টি সম্পর্কে যথার্থ ধারণা গঠন সম্ভব।
২. কিশোর অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির কারণগুলি প্রকল্পটির মাধ্যমে সহজেই জানা সম্ভব।
৩. প্রকল্পটির মাধ্যমে কিশোর অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টি সম্পর্কে জানা সম্ভব।
৪. ভারতে কিশোর অপরাধ প্রবণতা প্রতিরোধে যেসকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে - প্রকল্পটিতে সেসম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা প্রদান করা হয়েছে।
৫. কিশোর অপরাধ প্রবণতা প্রসঙ্গে বিভিন্ন চিকিৎসক , মনস্তত্ত্ববিদ ও সমাজতত্ববিদদের মূল্যবান আলোচনা প্রকল্পটিকে সমৃদ্ধ করেছে।
৬. কিশোর অপরাধ প্রবণতা প্রতিরোধে যেসকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে - সেগুলির যথার্থতা , বাস্তবতা ও কার্যকারিতা - সম্পর্কে প্রকল্পটিতে মূল্যবান আলোচনা সংযোজিত হয়েছে।
৭. প্রকল্পটির মাধ্যমে কিশোর অপরাধের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্টগুলি সম্পর্কে জানা সম্ভব।
৮. আন্তর্জাতিক স্তরে কিশোর অপরাধ প্রবণতা সম্পর্কে বিভিন্ন গবেষণা চলছে ও বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রকল্পটিতে এই বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা বর্তমান।
৯. প্রকল্পটির মাধ্যমে কিশোর অপরাধ সংক্রান্ত সাংবিধানিক বিষয়গুলি সম্পর্কে সহজেই জানা সম্ভব।
১০. সর্বোপরি , প্রকল্পটি কিশোর অপরাধ প্রবণতার বিষয়টি সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের কৌতূহলী করে তুলতে সহায়তা করবে।
কর্মপরিকল্পনা ও পদ্ধতিগত দিক :-
'' কিশোর অপরাধ প্রবণতা '' শীর্ষক প্রতিবেদনমূলক প্রকল্পটি রচনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদ্ধতি ও পরিকল্পনা অনুসৃত হয়েছে। এগুলি হল -
# বিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিষয়ের মাননীয় / মাননীয়া শিক্ষক / শিক্ষিকা কর্তৃক প্রকল্পের বিষয়বস্তু নির্বাচন।
# মাননীয় শিক্ষক / মাননীয়া শিক্ষিকার নির্দেশমত প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করার পরিকল্পনা করা হয়। সেই পরিকল্পনা অনুসারে পাঠ্যপুস্তক ও বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার থেকে বিভিন্ন পুস্তক গ্রহণ করে সেগুলি থেকে প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
# সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে একটি খসড়া প্রতিবেদন রচনা করা হয়।
# খসড়া প্রতিবেদনটি মাননীয় শিক্ষক / মাননীয়া শিক্ষিকার নিকট উপস্থাপন করা হলে তিনি প্রয়োজনীয় সংশোধনের নির্দেশদান করেন।
# মাননীয় শিক্ষক / মাননীয়া শিক্ষিকার নির্দেশমত প্রয়োজনীয় সংশোধনের পর প্রতিবেদনটি পুনরায় লিপিবদ্ধ করা হয়।
# প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় চিত্র প্রতিবেদনটিতে সংযোজন করা হয়।
# পূর্ণাঙ্গ প্রকল্পটিকে বিদ্যালয়ে জমা দেওয়া হয়।
তথ্য সংগ্রহ :-
বিদ্যালয়ের মাননীয় শিক্ষক / মাননীয়া শিক্ষিকা - র নির্দেশমত নিমলিখিত তথ্যগুলি সংগ্রহ করা হয়।
কিশোর অপরাধের বিভিন্ন কারণ :-
শিশু ও কিশোর অপরাধ অনুষ্ঠিত হওয়ার পেছেনে যেসকল উপাদান দায়ী সেগুলি মূলতঃ দুই ভাগে বিভক্ত - ব্যক্তিগত ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশমূলক। শিশু ও কিশোর অপরাধ সংগঠিত হওয়ার পেছনে দায়ী বিভিন্ন কারণগুলি হল -
১. পরিবারের ভূমিকা :- মনস্তাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিকরা মনে করেন - প্রাক শৈশব অভিজ্ঞতা , আবেগীয় অবদমন , শিশু গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ত্রুটি - বিচ্যুতি - ইত্যাদি বিষয়গুলি শিশু ও কিশোর অপরাধ সংগঠন করার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্যক্তিত্ব গঠন , উন্নয়ন , মূল্যবোধ , জীবনশৈলীর শিক্ষা - ইত্যাদি ক্ষেত্রে যথার্থ প্রতিপালন করা না হলে তা শিশু ও কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবন মানসিকতা গড়ে তোলে।
২. পারিপার্শ্বিক পরিবেশ :- পারিপার্শ্বিক ক্ষেত্রে শিশু ও কিশোরদের প্রতি বিরূপ আচরণ , প্রচলিত সংস্কৃতির সঙ্গে দ্বন্দ্ব , কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা , বয়স্কদের সামাজিক ভূমিকা , নৈতিকতার শিক্ষার অভাব - ইত্যাদি বিষয়গুলি শিশু ও কিশোরদের মনস্তাত্ত্বিক জগতে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। পারিপার্শ্বিক পরিবেশের ব্যাপক বৈপরীত্য ধীরে ধীরে কিশোর মনকে অপরাধ প্রবণ করে তোলে।
৩. মূল্যবোধের অবক্ষয় :- বর্তমান প্রতিটি সমাজে চিরাচরিত মূল্যবোধের ক্রমাগত অবক্ষয় ঘটছে। এর জন্য দায়ী বিশ্বায়ন , মুক্ত বাজার অর্থনীতি , দারিদ্রতা , কর্মসংস্থানের অভাব - ইত্যাদি। ইতিবাচক মূল্যবোধ মানুষকে নৈতিকতার মানদন্ডে উপরের দিকে রাখে। কিন্তু ধীরে ধীরে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটার ফলে শিশু ও কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৪. উত্তেজক চলচ্চিত্র ও পর্নোগ্রাফি :- উত্তেজক চলচ্চিত্র ও পর্নোগ্রাফি শিশু ও কিশোর মনকে নেতিবাচক করে তোলে ; তাদের মধ্যে উশৃঙ্খল জীবন যাপনের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। ধূমপান , মদ্যপান , ড্রাগ - সেবন - ইত্যাদি প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এগুলির সামগ্রিক ফল হিসাবে শিশু ও কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায় , হিরোইজম , কঠোর মনোভাব , অপরাধ সংগঠনের প্রতি আকর্ষণ - ইত্যাদি বৃদ্ধি পায়।
৫. সুনির্দিষ্ট নীতির অভাব :- শিশু ও কিশোর অপরাধ প্রবণতা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নীতির অভাবে বিষয়টি দিনে দিনে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে। উপযুক্ত পাঠক্রমের অভাব , মনস্তাত্ত্বিক কাউন্সিলিংয়ের অভাব , আচরণ সংশোধনমূলক পদক্ষেপের অভাব - ইত্যাদি বিষয়গুলি শিশু ও কিশোর অপরাধকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করছে।
শিশু ও কিশোর অপরাধ প্রবণতার বৈশিষ্ট :-
(ক ) অপরাধের হার উত্তর কৈশোর অর্থাৎ ১২ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে অনেক বেশি দেখা যায়।
(খ ) গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলে শিশু ও কিশোর অপরাধ প্রবণতার হার বেশি।
(গ ) যথার্থ শিক্ষার অভাব অপরাধ বৃদ্বির একটি অন্যতম কারণ।
(ঘ ) শিশু ও কিশোর অপরাধ প্রবণতার মূল কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যাবে দারিদ্রতা ও অর্থনৈতিক দুরবস্থাই হল এর মূল কারণ।
(ঙ ) কিশোরীদের তুলনায় কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা অধিক মাত্রায় লক্ষ্য করা যায়।
(চ ) যেসকল শিশু পিতা - মাতা ও অন্যান্য অভিভাবকের সঙ্গে থাকে তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতার হার বেশি।
(ছ ) ভারতে সংগঠিত কিশোর অপরাধ সংগঠনের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।
শিশু ও কিশোরদের অপরাধ প্রবণতা প্রতিরোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ / কর্মসূচি :-
১. ১৮৫০ সালে Apprentice Act চালু করে বলা হয় যে শাস্তিপ্রাপ্ত কিশোরদের জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে ; যার ফলে শাস্তিপ্রাপ্ত কিশোররা সমাজের মূলস্রোতে ফিরে যেতে পারবে।
২. ১৯৭৬ সালে Reformatory School Act চালু করা হয়। এই আইনের মাধ্যমে বলা হয় ১৫ বছরের কম বয়স্ক শিশুরা শাস্তিপ্রাপ্ত হলে তাদের সংশোধনমূলক প্রতিষ্ঠানে তিন - চার বছরের বিশেষ সংশোধনাত্মক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
৩. ১৯৬০ সালে কেন্দ্রীয় সরকার কিশোরদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার জন্য কিশোর অপরাধ সংক্রান্ত স্বতন্ত্র আদালত গঠন করে এবং দুঃস্থ কিশোরদের দেখাশোনার ভার শিশু কল্যাণ পর্ষদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়।
৪. ১৯৮৬ সালে Juvenile Justice Act চালু করা হয়। এই আইনের মাধ্যমে কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে একটি ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
৫. Juvenile Board গঠনের মাধ্যমে অভিভাবকহীন কিশোরদের অপরাধ মুক্তির পর তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
৬. কিশোর অপরাধীদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে বহু সংশোধনমূলক আবাস গড়ে তোলা হয়েছে। যেমন পশ্চিমবঙ্গের লিলুয়া হোম , বারাসাতের কিশলয় - ইত্যাদি।
৭. শিশু ও কিশোর অপরাধ প্রবণতা প্রতিহত করতে মনিটরিং এবং মূল্যায়ন সংক্রান্ত কর্মসূচিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
১. শিশু ও কিশোর অপরাধ প্রবণতা বিষয়টি নিয়ে আধুনিককালে বিশদে আলোচনা হলেও সমস্যাটির সূত্রপাত কিন্তু নতুন নয়। সমস্যাটি সর্বদায় প্রতিটি সমাজে বিরাজমান ছিল ; কিন্তু বর্তমানে সমস্যাটি নিয়ে সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
২. অপরাধ প্রবণতার জন্ম নেয় মানব মনের গহীনে। সাধারণতঃ পরিবারের লালন পালনের ক্ষেত্রে ত্রুটি বিচ্যুতি , পারিপার্শ্বিক ঘটনাপ্রবাহ , মানসিক অসঙ্গতি , ভোগবাদের বিস্তার - ইত্যাদি বিষয়গুলিকে সাধারণতঃ শিশু ও কিশোর অপরাধ প্রবণতার জন্য দায়ী করা হয়।
৩. বর্তমান আধুনিক সমাজে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। মানুষ সহযোগিতা , মানবিকতা , সহমর্মিতা - ইত্যাদি ভুলে গিয়ে তীব্রভাবে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। এর ফলে একদিকে যেমন মানুষ হতাশাবোধ ও হীনমন্যতায় ভুগছে , তেমনি অন্যদিকে শিশু ও কিশোর মনকে তা ভারাক্রান্ত করে তুলছে।
৪. বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে পণ্যের সহজলভ্যতা , পর্নোগ্রাফির রমরমা ও সহজলভ্যতা , কিছু অশ্লীল সাহিত্য , ভিডিও গেমের প্রতি আসক্তি , ড্রাগ সহ অন্যান্য নেশার প্রতি আসক্তি - ইত্যাদি বিষয়গুলি শিশু ও কিশোরমনের সুকোমল বৃত্তিগুলিকে বিলুপ্ত করে তুলছে। এর ফলে শিশু ও কিশোররা সুস্থ সংস্কৃতির পরিবর্তে এক বিকৃত সংস্কৃতির শিকার হয়ে পড়ছে। এর ফলেই বাড়ছে শিশু ও কিশোর অপরাধ প্রবণতা।
৫. শিশু ও কিশোর অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির সঙ্গে আধুনিক শিক্ষার একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকতার শিক্ষার অভাব লক্ষণীয়। ফলে শিশু ও কিশোরদের মধ্যে নৈতিকতার অভাব ঘটছে। নৈতিকতার শিক্ষার অভাবে শিশু ও কিশোরদের মধ্যে এক গভীর যন্ত্রণাবোধ ও মানসিক অস্থিরতা তৈরী হচ্ছে। এর অনিবার্য পরিণতিতে শিশু ও কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৬. শিশু ও কিশোরদের অপরাধ প্রবণতা প্রতিরোধ করতে সরকারি পদক্ষেপগুলি প্রশংসনীয় হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কর্মসূচীগুলি খাতা ও ফাইলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। সংশোধনমূলক হোম গুলিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ , নিম্নমানের খাদ্য পরিবেশন , যথার্থ প্রশিক্ষণের অভাব , বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের অভাব - ইত্যাদি কারণে বেশিরভাগ অভিভাবকেরাই নিজেদের অপরাধ প্রবন সন্তানকে এই সকল হোমে পাঠাতে চান না।
৭. শহরাঞ্চলে যেহেতু যোগাযোগের সহজলভ্যতা রয়েছে , পণ্যপ্রাপ্তির সহজলভ্যতা রয়েছে , এবং শিশু ও কিশোরদের অপরাধ প্রবন হওয়ার সবগুলি কারণের অস্তিত্ব রয়েছে - তাই গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলে শিশু ও কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা অধিক পরিমানে দেখা যায়।
৮. অপরাধপ্রবন শিশু ও কিশোরদের পুনর্বাসনের নীতি গৃহীত হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় নগন্য। যথাযথ পুনর্বাসনের অভাবে সমাজ থেকে শিশু ও কিশোর অপরাধপ্রবণতার বিষাক্ত বীজটিকে উৎখাত করা সম্ভব হচ্ছে না।
৯. বিচারপতি কৃষ্ণ আয়ার বলেছেন - কিশোর অপরাধীদের জন্য নির্ধারিত সংশোধনাগারগুলি কোনোমতেই স্বাস্থ্যকর নয়। তাছাড়া একসঙ্গে বহু অপরাধীকে ধরে রাখার ফলে তাদের খাদ্য , স্বাস্থ্য - ইত্যাদি বিষয়গুলি উন্নতমানের নয়। পুনর্বাসনের কর্মসূচীগুলি কাগজে কলমে থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা বাস্তবায়িত হয়না। এর ফলে মাঝে মধ্যেই কিশোর আবাসিকরা আবাসিক কর্তৃপক্ষের বিরোধিতা করে , কেউ কেউ পালিয়ে যায় , কেউ কেউ আবার নতুন করে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে।
১০. Juvenile Justice Act 1986 কে কেন্দ্র করে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে সমন্বয়সাধনের চেষ্টা করা হলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি। কিশোর অপরাধীদের জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধা প্রদানের কথা ঘোষণা করা হলেও সেরকম কোনো কর্মসূচি গৃহীত হয়নি। অপরাধপ্রবণ কিশোরদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের অভাবে তারা সমাজের মূল স্রোতে ফিরে এসে নতুন করে জীবনধারণ করার সুযোগ পাচ্ছে না।
পরিশেষে বলা যায় যে , শিশু ও কিশোর অপরাধ প্রবণতার বিষয়টিকে একটি সংবেদনশীল ও স্পর্শকাতর বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করে গৃহীত কর্মসূচিগুলিকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করলে , পুনর্বাসন এবং প্রতিরোধমূলক কর্মসূচিগুলিকে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি - এই দুইভাবে ভাগ করে বাস্তবায়িত করলে , অভিভাবকদের নিয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করলে - শিশু ও কিশোর অপরাধ প্রবণতা কিছুটা লাঘব হবে বলে আশা করা যায়। বস্তি , ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা - ইত্যাদি অঞ্চলে মনিটরিং নিয়মিত রাখতে হবে ; এছাড়াও যেসকল কর্মসূচিগুলি বর্তমানে চালু আছে তা রূপায়ণ করতে যে সকল কর্মীরা নিযুক্ত আছেন - তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
সীমাবদ্ধতা :-
প্রকল্পটি রূপায়নকালে এবং রূপায়িত হওয়ার পর যেসকল সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি বিচ্যুতি দৃষ্টিগোচর হয়েছে - সেগুলি হল -
১. প্রতিবেদনটিতে শিশু ও কিশোর অপরাধ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলোচনা করা হয়নি।
২. প্রতিবেদনে রাশি তথ্য অনুপস্থিত।
৩. কিশোর অপরাধ প্রবণতা দূর করতে যেসকল সংগঠন কাজ করছে - তাদের ভূমিকা প্রসঙ্গে প্রতিবেদনটিতে আলোচনা সীমাবদ্ধ।
৪. ভারতে কিশোর অপরাধ প্রবণতা প্রশমন করতে যেসকল উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে - সেগুলির আলোচনা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত।
৫. বিষয়টি সম্পর্কে কোনোরূপ সমীক্ষা করা হয়নি।
৬. কিশোর অপরাধীদের পুনর্বাসনের বিষয়টি তথ্য সহকারে আলোচনা করা হয়নি।
গ্রন্থপঞ্জি :-
যেসকল গ্রন্থগুলি থেকে প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে , সেগুলি হল -
১. ভারতীয় সামাজিক সমস্যা - বাণী প্রকাশন।
২. ভারতীয় সমাজ - অনাদিকুমার মহাপাত্র।
৩. Helps to the study of WBCS Sociology - Oriental Publication.
৪. শিক্ষাতত্ত্ব - সুশীল রায়।
৫. উচ্চমাধ্যমিক সমাজতত্ত্ব ( দ্বাদশ ) - অরুনাংশু প্রধান।
0 comments