উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবিজ্ঞান প্রকল্প : বিদ্যালয়ছুট সমস্যা ও তার সমাধান।
বিদ্যালয়ছুট বা স্কুলছুট সমস্যা।
বিদ্যালয়ছুট সমস্যার কারণ ও প্রতিকার।
শিক্ষাবিজ্ঞান প্রকল্প : বিদ্যালয়ছুট সমস্যা ও তার সমাধান।
ভূমিকা :-
ইংরেজ শাসনে ভারত নিরক্ষরতার অতল অন্ধকারে নিমজ্জিত। স্বাধীনতালাভের পরবর্তীকালে ভারতে প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তারের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ভারতীয় সংবিধানের ৪৫ নং ধারায় ৬-১৪ বছর বয়সী শিশুদের অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। তবে প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার ও শিক্ষার উদ্দেশ্যপূরণ যেসকল উপাদানগুলির দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম একটি উপাদান হল - বিদ্যালয়ছুট বা স্কুলছুট সমস্যা। প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের শেষ ধাপে পৌঁছনোর আগেই বহু শিশু বিদ্যালয় ছেড়ে চলে যায়। এর ফলে প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য অপূর্ণ থেকে যায়। একেই স্কুলছুট বা Drop - out বলা হয়। মূলতঃ আর্থ - সামাজিক পরিস্থিতিকে এর জন্য দায়ী করা হলেও পাঠক্রম , বিদ্যালয়ের পরিবেশ , পরীক্ষা পদ্ধতি ও শিক্ষকের ভূমিকাও এর জন্য দায়ী।
বর্তমান প্রতিবেদনমূলক প্রকল্পটিতে বিদ্যালয়ছুট সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করার সঙ্গে সঙ্গে সমস্যার কারণ , বিভিন্ন উপাদানের ভূমিকা এবং স্কুলছুট সমস্যার সমাধানকল্পে সাধারণ সূত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আলোকপাত করা হয়েছে।
যেসকল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রকল্পটি রূপায়ণ করা হয়েছে - সেগুলি হল -
১. বাস্তবতার নিরিখে স্কুলছুট সমস্যাটিকে পর্যালোচনা করা।
২. স্কুলছুট সমস্যার কারণগুলিকে অনুসন্ধান করা।
৩. স্কুলছুট সমস্যার জন্য দায়ী বিভিন্ন উপাদানগুলির ভূমিকা পর্যালোচনা করা।
৪. স্কুলছুট সমস্যার বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরা।
৫. স্কুলছুট সমস্যার সমাধানের জন্য সাধারণ সূত্র প্রতিষ্ঠা করা।
৬. সর্বপরি স্কুলছুট সমস্যার মত একটি জ্বলন্ত সমস্যা সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন করে তোলা।
প্রকল্পের গুরুত্ব :-
যেসকল কারণে প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতে পারে - সেগুলি হল -
১. প্রকল্পটির মাধ্যমে স্কুলছুট সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সম্ভব।
২. স্কুলছুট সমস্যার কারণগুলি অনুধাবন করতে প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ।
৩. স্কুলছুট সমস্যার জন্য দায়ী বিভিন্ন উপাদানগুলির ভূমিকা সম্পর্কে জানতে প্রকল্পটি কার্যকরী।
৪. প্রকল্পটির মাধ্যমে স্কুলছুট সমস্যার বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
৫. স্কুলছুট সমস্যার সমাধানকল্পে প্রকল্পটিতে উল্লিখিত সাধারণ সূত্রগুলি বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
৬. সর্বোপরি , প্রকল্পটির মাধ্যমে স্কুলছুট সমস্যা সম্পর্কে সচেতন করে তোলা সম্ভব।
কর্মপরিকল্পনা / পদ্ধতিগত দিক :-
প্রকল্পটি নির্মাণ করতে যেসকল পদ্ধতি ও পরিকল্পনা অনুসরণ করা হয়েছে সেগুলি হল -
>> বিদ্যালয়ের শিক্ষাবিজ্ঞান বিষয়ের মাননীয় শিক্ষক / মাননীয়া শিক্ষিকা X মহাশয় / মহাশয়া কর্তৃক প্রকল্পের বিষয়বস্তু নির্বাচন।
>> বিষয় নির্বাচনের পর মাননীয় শিক্ষক মহাশয় / মাননীয়া শিক্ষিকা মহাশয়া - প্রকল্প রূপায়ণের জন্য প্রয়োজনীয় পদ্ধতিগত দিকগুলি সম্পর্কে আলোকপাত করেন।
>> মাননীয় শিক্ষক মহাশয় / মাননীয়া শিক্ষিকা মহাশয়া - র নির্দেশমত বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠ করে প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
>> সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে একটি খসড়া প্রতিবেদন রচনা করে সেটি মাননীয় শিক্ষক / মাননীয়া শিক্ষিকার নিকট উপস্থাপন করা হয় এবং তিনি প্রয়োজনীয় সংশোধনের নির্দেশ প্রদান করেন।
>> মাননীয় শিক্ষক / মাননীয়া শিক্ষিকার নির্দেশমত প্রয়োজনীয় সংশোধনের পর পুনরায় প্রকল্পটি প্রস্তুত করা হয়।
>> প্রয়োজনীয় চিত্র সংগ্রহ করে সেগুলি প্রতিবেদনে সংযোজিত করা হয়।
>> পূর্ণাঙ্গ প্রকল্পটি বিদ্যালয়ে জমা দেওয়া হয়।
বর্তমান ভারতে প্রাথমিক শিক্ষার সর্বজনীকরণ , শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যপূরণ যেসকল উপাদানগুলির দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হল স্কুলছুট সমস্যা। স্কুলছুট সমস্যার জন্য দায়ী মূলতঃ ভারতের আর্থ - সামাজিক পরিকাঠামো। তবে এর সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যালয় , পাঠক্রম , শিক্ষক ও অভিভাবকের ভূমিকাও স্কুলছুট সমস্যার জন্য সমান দায়ী। যেসকল উপাদানগুলি স্কুলছুট সমস্যার জন্য দায়ী সেগুলি হল -
১. ত্রুটিপূর্ণ পাঠক্রম :- বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতিহীন পাঠক্রম স্কুলছুট সমস্যার জন্য বিশেষভাবে দায়ী। প্রচলিত পাঠক্রমের সঙ্গে বৃত্তি উপার্জনের কোনো সম্পর্ক না থাকায় শিক্ষার্থীরা এই ধরণের পাঠক্রম গ্রহণ করতে উৎসাহবোধ করেনা।
২. পাঠদান পদ্ধতির ত্রুটি :- অনেকসময় ত্রুটিপূর্ণ পাঠদান পদ্ধতি পাঠ্য বিষয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের অনিচ্ছার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ত্রুটিপূর্ণ পাঠদান পদ্ধতি পাঠ্য বিষয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়। এর ফলে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে বিরক্তবোধ করে।
৩. আর্থ - সামাজিক পরিকাঠামো :- স্কুলছুট সমস্যার জন্য সর্বাধিক দায়ী হল শিক্ষার্থীদের আর্থ - সামাজিক পরিকাঠামো। অর্থের অভাব , চরম দারিদ্রতা , খাদ্যের অভাব - ইত্যাদি কারণে শিক্ষার্থীরা সহজেই বিদ্যালয় ছেড়ে দিয়ে উপার্জনমূলক কর্মে নিজেকে নিযুক্ত করে।
৪. শিশু শ্রম আইনের প্রয়োগের অভাব :- ভারতে ১৪ বছরের নীচে শিশুদের কর্মে নিযুক্ত করানো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ থাকলেও বাস্তবে ভিন্ন পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। অর্থের প্রয়োজনে বিপুল সংখ্যক শিশুরা আজ ভারতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মরত। শিশু আইনের ব্যর্থতা স্কুলছুট সমস্যার অনুকূল পরিস্থিতি তৈরী করে।
৫. অভিভাবকদের দায়িত্ব :- অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের বিদ্যালয়ছুট হওয়ার পেছনে অভিভাবকরা দায়ী থাকেন। অর্থের প্রয়োজনে বা অন্য কোনো কারণে শিশুকে বিদ্যালয়ে পাঠানোর তুলনায় কর্মক্ষেত্রের দিকে ঠেলে দেওয়াতেই অধিক উৎসাহবোধ করেন।
৬. শিক্ষকের দায়িত্ব :- অনেকসময় শিক্ষার্থীর প্রতি শিক্ষকের নির্মম আচরণ ও শাস্তিদানের ব্যবস্থা বিদ্যালয় সম্পর্কে শিশুর মনে ভীতির সঞ্চার করে। এই ভীতি চরম পর্যায়ে পৌঁছলে তার ফল হিসাবে দেখা যায় বিদ্যালয়ছুট সমস্যা।
৭. বৃত্তিশিক্ষার অভাব :- বিদ্যালয়ের সাধারণ পাঠক্রমে বৃত্তিশিক্ষার নিদারুন অভাব লক্ষণীয়। ভারতে বিপুল সংখ্যক মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করেন। শিক্ষার তুলনায় ভারতে আর্থিক রোজগারের চাহিদা তাই স্বাভাবিকভাবেই বেশি। কিন্তু বিদ্যালয়ে বৃত্তিশিক্ষার অভাব শিশুকে বিদ্যালয়মুখী করে তোলার ক্ষেত্রে একটি প্রধান অন্তরায়।
৮. পরিকাঠামোগত সমস্যা :- বিদ্যালয়ে যথাযথ শ্রেণিকক্ষের অভাব , উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব , বিদ্যালয়ে পানীয় জল ও শৌচাগারের অভাব , বিদ্যালয়ের দূরত্ব , শিক্ষা উপকরণের অভাব - ইত্যাদি বিষয়গুলিও বিদ্যালয়ছুট সমস্যার জন্য দায়ী।
৯. বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ব্যর্থতা :- ভারতে বাল্যবিবাহ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হলেও ভারতে আজও প্রতি বছর বহু সংখ্যক নাবালিকার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সেই সকল বালিকারা বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
১০. সদিচ্ছার অভাব :- এক শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতৃত্ব , প্রশাসনিক কর্মচারি ও শিক্ষকদের উদাসীনতা ও সদিচ্ছার অভাবের ফলে সকল শিশুকে বিদ্যালয়মুখী করে তোলা এবং তাদের বিদ্যালয়ে ধরে রাখার ক্ষেত্রে একশো শতাংশ সফলতা পাওয়া যাচ্ছে না।
বিদ্যালয়ছুট সমস্যার সমাধান :-
বিদ্যালয়ছুট সমস্যা শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যগুলিকে ব্যর্থ করে তোলে। তাই বিদ্যালয়ছুট সমস্যার সমাধান হওয়া একান্ত প্রয়োজন। নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলির মাধ্যমে বিদ্যালয়ছুট সমস্যার বিরুদ্ধে ইতিবাচক সমাধানসূত্র প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। যেমন -
(i) বিদ্যালয়ে বাস্তব জীবনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ পাঠক্রম চালু করা।
(ii) শিক্ষার্থীর আগ্রহ সৃষ্টিকারী পাঠদান নীতির প্রণয়ন করা।
(iii) বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর ন্যুনতম জৈবিক চাহিদা ; যেমন - খাদ্য ও পুষ্টি , চিকিৎসা - ইত্যাদির ব্যবস্থা করা।
(iv) শিশুশ্রম আইনকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করা।
(v) অভিভাবকদের সচেতন করে তোলা।
(vi) বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পক্ষপাতমূলক আচরণ ও শাস্তিপ্রদান নিষিদ্ধ করা।
(vii) পরিকাঠামোগত সমস্যাগুলি দূর করা। যেমন - প্রতিটি বিদ্যালয়ে পানীয় জল , শৌচাগার ও উপযুক্ত শ্রেণীকক্ষের ব্যবস্থা করা।
(viii) কঠোরভাবে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা এবং এবিষয়ে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সচেতনতামূলক কর্মসূচীকে আরো জোরদার করে তোলা।
(ix) বিদ্যালয়ের সাধারণ পাঠক্রমের সঙ্গে বিভিন্ন বৃত্তিমূলক কোর্সের ব্যবস্থা করা এবং আর্থিক উপার্জন সংক্রান্ত বিশেষ কোর্স বা কর্মশালা আয়োজন করা।
(x) বিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে যুক্ত সকল ব্যক্তির অর্থপূর্ণ অংশীদারিত্ব ও দক্ষতা বৃদ্ধি করতে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং তার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কাজের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা।
ভারতে প্রাথমিক শিক্ষার সর্বজনীকরণের ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ছুট সমস্যাটি একটি প্রধান অন্তরায় - একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এরজন্য একটিকে আর্থ - সামাজিক পরিকাঠামো এবং অন্যদিকে বিদ্যালয় ও পাঠক্রমকেন্দ্রিক ত্রুটি - ইত্যাদি বিভিন্ন উপাদান দায়ী। তবে , বিদ্যালয়ছুট সমস্যার জন্য উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।
সরকারি পরিসংখ্যান থেকে একথা স্পষ্ট যে প্রতি বছর বহু সংখ্যক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ছুট হয়ে থাকে। ইতিপূর্বে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার , বিদ্যালয়ছুট সমস্যা দূরীকরণ , শিক্ষায় সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ - ইত্যাদির জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি একাধিক প্রকল্প ও কর্মসূচি গ্রহণ করে। এগুলির মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হল - জাতীয় সাক্ষরতা মিশন , সর্বশিক্ষা অভিযান ইত্যাদি। এইসকল কর্মসূচীগুলি কোনো একটি বিশেষ উদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে গৃহীত হয়নি ; এগুলির উদ্দেশ্য ছিল বহুবিধ। তবে সার্বিকভাবে বিচার করলে কর্মসূচিগুলির কিছুটা সুফল ভারতীয় শিক্ষার্থীদের নিকট এসে পৌচেছে। তবে এই সকল কর্মসূচিগুলির সম্পূর্ণ সুফল থেকে আমরা এখনো বঞ্চিত আছি।
বিগত দুই দশকে বিদ্যালয়ভিত্তিক বিদ্যালয়ছুটের হার শতাংশের বিচারে কিছুটা কমলেও বিদ্যালয়ছুটের প্রবণতা এখনো বন্ধ হয়নি। বিশেষ করে গ্রামীণ ভারতে , যেখানে বেশিরভাগ শিশুর পরিবার কৃষি ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত , সেখানে বিদ্যালয়ছুটের হার একই সঙ্গে উদ্বেগের ও হতাশার। কৃষিভিত্তিক পরিবারগুলি শিশুকে বিদ্যালয়ে পাঠানোর পরিবর্তে কৃষিক্ষেত্রে নিযুক্ত করাতে অধিক উৎসাহী হয়ে থাকেন। অন্যদিকে নগরকেন্দ্রিক শিল্প সমাজে শিশুরা যেকোনো ধরণের কায়িক শ্রমমূলক কর্মে নিযুক্ত হয়ে পড়ে।
বিদ্যালয়ছুট সমস্যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তিনটি চরম ক্ষতিকর সমস্যার জন্ম দেয় -
১. বাল্যবিবাহ ,
২. শিশু ও নারী পাচার ,
৩. ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের নিয়োগ।
উক্ত তিনটি সমস্যা আবার নানাভাবে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার জন্ম দেয়। কেবলমাত্র বিদ্যালয়ছুট সমস্যার সমাধান করা গেলেই উপরোক্ত সর্বপ্রকারের সমস্যাগুলির সমাধান করা সম্ভব।
যেহেতু ভারতে বেশিরভাগ মানুষ দরিদ্র ও নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং বহু সংখ্যক মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করেন , তাই ভারতীয় প্রেক্ষাপটে বিচার করলে শিক্ষাকে সরাসরি উৎপাদনশীলতার সঙ্গে যুক্ত করে শিক্ষাকে সার্থকভাবে বৃত্তিমুখীকরণ ঘটানো উচিত। শিক্ষা শেষে হাতে কাজ পেলে , আর্থিক উপার্জনের রাস্তা খুলে গেলে বিদ্যালয়ছুট সমস্যার অনেকটাই সমাধান হবে বলে মনে করা হয়।
তবে এর সঙ্গে সঙ্গে শিশুর প্রতি অভিভাবকদের ভূমিকার আমূল পরিবর্তন দরকার। অভিভাবকদের এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে যে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা শিশুর জীবনকেও পূর্ণাঙ্গ করে তুলবে , বৃত্তিজগতের একাধিক দরজা তাদের জন্য উন্মুক্ত হবে , শিশু নিজের যোগ্যতা ও আগ্রহ অনুযায়ী বৃত্তি নির্বাচন করতে পারবে। এই সচেতনতা বিস্তারের কাজে শিক্ষক , শিক্ষাকর্মী , শিক্ষার্থী এবং সর্বোপরি সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে।
বিদ্যালয়ছুট সমস্যা যে কেবলমাত্র একটি শিশুর জীবনকে অন্ধকারাচ্ছন্ন ও ক্ষতিগ্রস্থ করে তা'ই নয় ; এর সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র জাতি ও মানব সমাজেরও ক্ষতিসাধন করে। তাই বিদ্যালয়ছুট সমস্যার সমাধানকল্পে অবিলম্বে বাস্তব সম্মত নীতি গ্রহণ করে তা সার্থকভাবে প্রয়োগ করা দরকার।
উপসংহার / সিদ্ধান্ত গ্রহণ :-
বিদ্যালয়ছুট সমস্যা যে শুধুমাত্র ভারতকে জর্জরিত করেছে - তা নয় ; বর্তমানে এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। এরজন্য মূল দায়ী আর্থ - সামাজিক পরিকাঠামো হলেও ত্রুটিপূর্ণ পাঠক্রম , শিক্ষকের ভূমিকা , অভিভাবকদের সচেতনতার অভাব , বাস্তব সম্মত নীতির অভাব , বিদ্যালয়ে বৃত্তিশিক্ষার অভাব , বাল্য বিবাহ ও শিশু শ্রম আইনের পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগে ব্যর্থতা - ইত্যাদি উপাদানগুলির ভূমিকাও অস্বীকার করা যায়না।
বিদ্যালয়ছুট সমস্যা শুধুমাত্র নিজে একটি একক সমস্যা নয় ; এর সঙ্গে সঙ্গে তা জন্ম দেয় একাধিক সামাজিক সমস্যার। বিদ্যালয়ছুট সমস্যা একটি শিশুর জীবনকে ক্ষতিগ্রস্থ করার সঙ্গে সঙ্গে তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জনসমাজের উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে মেঘাচ্ছন্ন করে তোলে। তাই বিদ্যালয়ছুট সমস্যার সমাধানে সমস্ত রকমের অবহেলা ও উদাসীনতাগুলিকে দূর করে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বিদ্যালয়ছুট সমস্যার সমাধানের জন্য বিদ্যালয় , নীতি নির্ধারক , শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী , অভিভাবক তথা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ইতিবাচক অংশগ্রহণ প্রয়োজন। একদিকে দেখতে হবে নতুন করে একটি শিশুও যাতে বিদ্যালয়ছুট না হয় এবং অন্যদিকে ইতিমধ্যে বিদ্যালয়ছুট হয়ে যাওয়া শিশুদের সাধ্যমত পুনর্বাসনের নীতি গ্রহণ করতে হবে।
সীমাবদ্ধতা :-
প্রকল্পটি রূপায়নকালে এবং রূপায়িত হওয়ার পর যেসকল ত্রুটি - বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতা দৃষ্টিগোচর হয়েছে - সেগুলি হল -
১. কোনো পাঠ্যপুস্তক , সহায়ক গ্রন্থ , পত্র - পত্রিকা , ইন্টারনেট বা অন্য কোনো মাধ্যম থেকে বিদ্যালয়ছুট শিক্ষার্থীদের প্রকৃত পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি ; ফলে প্রতিবেদনেও তার কোনো উল্লেখ নেই।
২. পাঠ্যপুস্তক বা সহায়ক গ্রন্থগুলিতে বিদ্যালয়ছুট সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও সীমাবদ্ধ। তাই তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
৩. প্রতিবেদনমূলক প্রকল্প রচনার সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিদ্যালয়ছুট সমস্যার মত একটি জটিল ও বৃহৎ সমস্যাকে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা সম্ভব হয়নি।
৪. প্রতিবেদনটিতে বিদ্যালয়য়ের শিক্ষক - শিক্ষিকা ও অভিভাবকদের মতামত অনুপস্থিত।
৫. বিভিন্ন কর্মসূচি ও সরকারি প্রকল্পগুলি বিদ্যালয়ছুট সমস্যার সমাধানকল্পে এযাবৎকাল যে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে - তার আলোচনা প্রতিবেদনটিতে অনুপস্থিত।
৬. স্থানীয় এলাকার বিভিন্ন বিদ্যালয়গুলিতে বিদ্যালয়ছুট সমস্যার প্রকতি বিষয়ে আলোচনা করা হয়নি এবং পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হয়নি।
গ্রন্থপঞ্জি :-
প্রতিবেদনটি রচনার জন্য তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে যে সকল গ্রন্থের সাহায্য নেওয়া হয়েছে - সেগুলি হল -
১. উচ্চমাধ্যমিক সমাজতত্ত্ব - ডক্টর অরুনাংশু প্রধান।
২. উচ্চমাধ্যমিক সমাজবিদ্যা - ডক্টর মৃনাল কান্তি দত্ত।
৩. বি এ ভারতীয় সামাজিক সমস্যা - বাণী প্রকাশন।
৪. রাজনীতিক সমাজতত্ত্ব ( স্নাতক ) - অনাদিকুমার মহাপাত্র।
৫. ভারতীয় সমাজ ( স্নাতক ) - অনাদিকুমার মহাপাত্র।