উচ্চমাধ্যমিক প্রকল্প : বিশ্বায়ন।
উচ্চমাধ্যমিক প্রকল্প : বিশ্বায়ন।
বিশ্বায়ন সম্পর্কিত প্রকল্প রচনা।
বিশ্বায়ন।
[ বিশ্বায়ন বিষয়টি একটি প্রগতিশীল বিষয়। ইতিহাস , রাষ্ট্রবিজ্ঞান , সমাজতত্ত্ব - ইত্যাদি সকল বিষয়েই বিশ্বায়ন ধারণাটি আলোচনা করা হয়েছে। তাই যেকোনো বিষয়েই বিশ্বায়ন সম্পর্কে প্রকল্প রূপায়ণ করা যেতে পারে। ]
বিশ্বায়ন।
ভূমিকা :-
বিশ্বায়ন বা Globalisation শব্দটি সাম্প্রতিককালে বহু ব্যবহৃত হলেও বিশ্বায়নের কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নেই। জোসেফ স্টিগলিট্স - এর মতে , বিশ্বায়ন হল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জনগণের মধ্যে এমন ঘনিষ্ঠ সংহতিসাধন যা পরিবহণ ও যোগাযোগের ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস করেছে এবং দ্রব্যসামগ্রী , পরিষেবা , পুঁজি , জ্ঞান এমনকি পৃথিবী জুড়ে মানুষের অবাধ যাতায়াতের অধিকারের ওপর আরোপিত কৃত্রিম বাধানিষেধকেও অতিক্রম করেছে। বিশ্বায়নের ফলে আজ গোটা বিশ্ব যেন একটি ভূবনগ্রামে পরিণত হয়েছে। ১৯৯০ এর দশকে অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতি গ্রহণের ফলে ভারতে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া আরো গভীরভাবে ত্বরান্বিত হয়। পুঁজি , পণ্য , মেধা , সংস্কৃতি , বাণিজ্য - ইত্যাদির অবাধ আদান - প্রদান শুরু হয়েছে বিশ্বায়নের হাত ধরে।
বর্তমান প্রকল্পটিতে বিশ্বায়নের ধারণা , বিশ্বায়নের বৈশিষ্ট ও প্রকৃতি এবং সাধারণ ও জনজীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বিশ্বায়নের প্রভাব সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।
যেসকল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রকল্পটি রূপায়ণ করা হয়েছে - সেগুলি হল -
১. বিশ্বায়ন সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা অর্জন।
২. বিশ্বায়ন সংগঠনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা।
৩. বিশ্বায়নের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন উপাদানগুলির সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করা।
৪. বিশ্বায়নের বৈশিষ্ট ও প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা অর্জন করা।
৫. মানুষের সাধারণ জীবনযাত্রা ও রাষ্ট্রীয় জীবনের উপর বিশ্বায়নের প্রভাব সম্পর্কে আলোকপাত করা।
৬. বিশ্বায়নের ক্ষতিকর দিকগুলি তুলে ধরা।
৭. সর্বোপরি , বিশ্বায়ন বিষয়টি সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের কৌতূহলী করে তোলা।
প্রকল্পের গুরুত্ব :-
যেসকল কারণে প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতে পারে , সেগুলি হল -
১. প্রকল্পটির মাধ্যমে সহজেই বিশ্বায়ন সম্পর্কে ধারণা অর্জন করা যাবে ও বিশ্বায়ন সংগঠনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা যাবে।
২. প্রকল্পটিতে বিশ্বায়নের ধারণা , বৈশিষ্ট ও প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এদিক দিয়ে বিচার করলে প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ।
৩. প্রকল্পটির মাধ্যমে আধুনিক বিশ্বের উপর বিশ্বায়নের প্রভাব সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা অর্জন সম্ভব।
৪. ভারতের সাধারণ জনজীবন ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের সুফল ও কুফলগুলি সম্পর্কে প্রকল্পটির মাধ্যমে জানা সম্ভব।
৫. সর্বোপরি প্রকল্পটির মাধ্যমে বিশ্বায়ন সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের কৌতূহল বৃদ্ধি সম্ভব।
কর্মপরিকল্পনা / পদ্ধতিগত দিক :-
প্রকল্পটি নির্মাণ করতে যেসকল পদ্ধতি ও পরিকল্পনা অনুসরণ করা হয়েছে সেগুলি হল -
>> বিদ্যালয়ের X বিষয়ের মাননীয় শিক্ষক / মাননীয়া শিক্ষিকা X মহাশয় / মহাশয়া কর্তৃক প্রকল্পের বিষয়বস্তু নির্বাচন।
>> বিষয় নির্বাচনের পর মাননীয় শিক্ষক মহাশয় / মাননীয়া শিক্ষিকা মহাশয়া - প্রকল্প রূপায়ণের জন্য প্রয়োজনীয় পদ্ধতিগত দিকগুলি সম্পর্কে আলোকপাত করেন।
>> মাননীয় শিক্ষক মহাশয় / মাননীয়া শিক্ষিকা মহাশয়া - র নির্দেশমত বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠ করে প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
>> সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে একটি খসড়া প্রতিবেদন রচনা করে সেটি মাননীয় শিক্ষক / মাননীয়া শিক্ষিকার নিকট উপস্থাপন করা হয় এবং তিনি প্রয়োজনীয় সংশোধনের নির্দেশ প্রদান করেন।
>> মাননীয় শিক্ষক / মাননীয়া শিক্ষিকার নির্দেশমত প্রয়োজনীয় সংশোধনের পর পুনরায় প্রকল্পটি প্রস্তুত করা হয়।
>> প্রয়োজনীয় চিত্র সংগ্রহ করে সেগুলি প্রতিবেদনে সংযোজিত করা হয়।
>> পূর্ণাঙ্গ প্রকল্পটি বিদ্যালয়ে জমা দেওয়া হয়।
বিশ্বায়নের ধারণা ও সংজ্ঞা :-
জন বেইলিস , প্যাট্রিসিয়া , স্টিভ স্মিথ সম্পাদিত The Globalisation of World Politics গ্রন্থে বলা হয়েছে সারা পৃথিবীতে সাধারণতঃ পাঁচটি অর্থে বিশ্বায়নকে বোঝানো হয়। এগুলি হল -
(A) আন্তর্জাতিকীকরণ - যা দেশের গন্ডি মুছে দিয়ে পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে বাড়িয়ে তোলে।
(B) উদারীকরণ - দেশের সকল বৈষয়িক বিষয়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়ে একটা খোলামেলা , সুসংহত বিশ্ব অর্থনীতি গড়ে তোলা।
(C) সর্বজনীন - বিশ্বের সকল প্রান্তের মানুষের ওপর এর প্রভাব সর্বব্যাপী ও সর্বজনীন।
(D) পশ্চিমিকরণ - উন্নত দেশগুলির বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন উন্নয়নশীল দেশগুলিকে প্রভাবিত করে।
(E) সীমান্তলোপকরণ - রাষ্ট্রীয় সীমান্ত সম্পর্কে কঠোর ব্যবস্থা হ্রাস করে সর্বক্ষেত্রে যাতায়াত সহজ করে তোলা।
সুতরাং , বিশ্বের বিভিন্ন দেশের , বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে অন্যান্য প্রান্তের মানুষের অবাধ বাণিজ্যিক , সাংস্কৃতিক , সামাজিক ও রাজনৈতিক যোগাযোগ , পারস্পরিক আদান প্রদান , বাজার অর্থনীতি প্রভৃতির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়াই হল বিশ্বায়ন।
বিশ্বায়নের বৈশিষ্ট :-
বিশ্বায়নের কতকগুলি অপরিহার্য ও মৌলিক বৈশিষ্ট রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল -
১. বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সংহতি স্থাপন :-
বিশ্বায়ন বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে নিবিড় সংহতি গড়ে তুলতে চায়। আধুনিক বিশ্বে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে একাকী বিচ্ছিন্নভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি পরিচালনা করা সম্ভব নয়। বিশ্বায়ন এই বাস্তবতাকে তুলে ধরে রাষ্ট্রগুলির মধ্যে একটি অভিন্ন যোগসূত্র গড়ে তুলতে চায়।
২. পারস্পরিক নির্ভরশীলতা :-
বিশ্বায়ন অত্যন্ত সচেতনভাবে সমগ্র বিশ্বে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ নির্বিশেষে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে একটি পারস্পরিক নির্ভরশীলতার পরিবেশ গড়ে তোলার পক্ষপাতী। নোয়াম চমস্কির মতে , বিশ্বায়নের উদ্দেশ্য হল বিশ্বের সমস্ত রাষ্ট্রের মধ্যে সক্রিয় সহযোগিতা স্থাপন করে পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে দৃঢ়তর করে তোলা।
৩. বহুজাতিক সংস্থার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা :-
বিশ্বায়নের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট হল , আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থা বা কর্পোরেট দুনিয়ার আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকে সুনিশ্চিত করা। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গবেষকরা মনে করেন , বর্তমান বিশ্বে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পাশাপাশি কর্পোরেট সংস্থাগুলির ভূমিকাও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
৪. পুঁজি ও প্রযুক্তির অবাধ চলাচল :-
বিশ্বায়নের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট হিসেবে আধুনিক বিশ্বে পুঁজি ও প্রযুক্তির অবাধ চলাচলের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়। বিশ্বায়নের যুগে পুঁজি , প্রযুক্তি ও কারিগরি কৌশল কোনো একটি রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে সীমায়িত হয়ে থাকেনি। বিশ্ব বাণিজ্যের অবাধ গতি এই বিষয়টিকে আরো সহজ করে তুলেছে।
৫. মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা :-
বিশ্বায়নের একটি প্রধান বৈশিষ্ট হল মুক্ত বাজার অর্থনীতি। বিশ্বায়ন সারা বিশ্বের বাজারকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত রাখতে চায়। বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে মনে করা হয় যে , বাণিজ্য ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণভাবে অবাঞ্চিত।
৬. রাষ্ট্রের সাবেকি সার্বভৌমত্বের পরিবর্তন :-
রাষ্ট্রের সাবেকি সার্বভৌম ক্ষমতার পরিবর্তনকে বিশ্বায়নের অন্যতম বৈশিষ্ট বলে মনে করা হয়। সাবেকি সর্বভৌমিকতায় মনে করা হয় , বাহ্যিক ক্ষেত্রে একটি রাষ্ট্রের যে অসীম বা চরম ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু বিশ্বায়ন তাকে অস্বীকার করে। বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে বাহ্যিক ক্ষেত্রে কোনো রাষ্ট্রই চরম সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়। পারস্পরিক নির্ভরশীলতার এই আধুনিক বিশ্বে , নয়া বিশ্ব ব্যবস্থার সদস্য হিসেবে ছোট - বড় সকল রাষ্ট্রকেই বাণিজ্য ক্ষেত্রে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ( WTO ) - র মত গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার নীতি ও নির্দেশ মেনে চলতে হয়।
৭. তথ্য - প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি :-
বিশ্বায়নের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট হল তথ্য - প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি। বিশ্বায়নের যুগে ইন্টারনেট সহ তথ্য প্রযুক্তির অবাধ বিচরণে জাতি রাষ্ট্রের নিয়ম কানুন কোনো অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারেনা। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা মনে করেন , তথ্য প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি ঘটিয়ে ইন্টারনেট বিপ্লবের মাধ্যমে জাতি রাষ্ট্রের সীমারেখাকে নিশ্চিহ্ন করে বিশ্বায়ন এক জাতি এক বিশ্বের এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইছে।
বিশ্বায়নের প্রকৃতি :-
১. অর্থনৈতিক দিক : -
বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার মূল ভিত্তি হল তার অর্থনৈতিক প্রকৃতি। আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার ( IMF ) , বিশ্বব্যাংক (World Bank ) এবং GATT ( General Agreement on Trade and Tariff ) চুক্তির পরবর্তী পর্যায়ে গঠিত বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা ( WTO ) অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের প্রক্রিয়াকে বাস্তবায়িত করে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রধান দিকগুলির মধ্যে রয়েছে বিশ্ববাণিজ্যের দ্রুত প্রসার , লগ্নি পুঁজির অবাধ আদান প্রদান , বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে অভিগমন ও নির্গমন , এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ ও অন্যান্য বিনিময় মাধমের সঞ্চালন , বহুজাতিক বাণিজ্য সংস্থার অবাধ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ , বিভিন্ন দেশের মধ্যে প্রযুক্তির আদান প্রদান , আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি ও তথ্য মাধমের বিস্তার ইত্যাদি।
২. রাজনৈতিক দিক :-
রাজনৈতিক দিক থেকে বিশ্বায়ন জাতি রাষ্ট্রের সংকট সৃষ্টি করেছে বলে অনেকে মনে করেন। বিশ্বায়ন জাতি রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতাকে খর্ব করে রাষ্ট্রকে একটি বাজার কেন্দ্রিক সংগঠনে পরিণত করেছে। অধ্যাপক হলটন তাঁর '' Globalization and The Nation State '' শীর্ষক রচনায় জাতি - রাষ্ট্রের ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন - জাতি রাষ্ট্রগুলি যে পৃথিবীতে বাস করে তার পরিবর্তন ঘটে চলেছে। বিশ্বায়ন হল এই পরিবর্তনের একটি প্রধান উৎস।
৩. সাংস্কৃতিক দিক :-
সাংস্কৃতিক দিক থেকে বিশ্বায়নের প্রধান লক্ষ্য হল সারা বিশ্বে এক সমজাতীয় সংস্কৃতি গড়ে তোলা। সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন ইন্টারনেটসহ অত্যাধুনিক গণমাধ্যমের সহায়তায় এক পণ্যমুগ্ধ ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রচার শুরু করেছে , এর ফলে আঞ্চলিক ও জাতীয় সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ণ হতে বসেছে। বিশ্বায়ন বহুমুখী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমূহকে এক ছাঁচে ঢেলে যে সমজাতীয় সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চায় তাকে অনেকে মার্কিনি ম্যাকডোনাল্ড সংস্কৃতি বলে আখ্যা দিয়েছেন।
কে এম পানিক্কর বিশ্বায়ন , সংস্কৃতি ও পণ্য সংক্রান্ত তাঁর এক প্রবন্ধে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন , সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বহুজাতিক সংগঠনগুলি বিশেষভাবে সক্রিয়। আজ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে যে সাংস্কৃতিক আক্রমণ চলছে সেটি সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার এক প্রচেষ্টা।
৪. পরিবেশগত দিক :-
পরিবেশবিদদের মতে , বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া বিশ্বের পরিবেশগত ক্ষেত্রে এক সংকট সৃষ্টি করেছে। কর্পোরেট বিশ্বের আধিপত্য প্রাকৃতিক পরিবেশকে শুধু যে বিনষ্ট করে চলেছে তাই নয় , তাকে পণ্যায়িত করেছে। পরিবেশবিদ বন্দনা শিবা তাঁর '' Globalization and Environment '' শীর্ষক এক নিবন্ধে লিখেছেন - পৃথিবীর মূল সম্পদগুলি হল স্থল , জল এবং পরিবেশগত বৈচিত্র্য। বিশ্বায়নের প্রভাবে এই স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক উপাদানগুলি পণ্যে রূপান্তরিত হচ্ছে। নতুন ধরণের সম্পদ হিসেবে এই উপাদানগুলি উপজাতি ও কৃষক সম্প্রদায়ের অধিকার থেকে নিষ্ক্রান্ত করে বিশ্বায়িত কর্পোরেশনগুলির নিজস্ব সম্পত্তিতে পরিণত করেছে।
প্রাপ্ত তথ্যগুলিকে নীচে বিশ্লেষণ আকারে উপস্থাপন করা হল।
১. উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে বৈষম্য :-
বিশ্বায়নের ফলে উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে বৈষম্য প্রকট হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার , বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা কর্তৃক গৃহীত বিশ্বায়নের নীতি উন্নয়নশীল তৃতীয় বিশ্বের পক্ষে বৈষম্যের সৃষ্টি করেছে। এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহ উন্নত দেশগুলির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এডওয়ার্ড এস হারমানের মতে , বিশ্বে সবচেয়ে ধনী ও দরিদ্র দেশে বসবাসকারী পৃথিবীর ২০ শতাংশ জনগণের আয়ের ফারাক ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ৩০ : ১ থেকে বেড়ে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে ৮২ : ১ হয়েছে।
২. বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাসম্পদ অধিকারের ( TRIPS ) প্রয়োগ :-
বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা বাণিজ্যিক বিশ্বায়নের নীতিকে কার্যকরী করার জন্য বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাসম্পদ অধিকারের যে চুক্তি বলবৎ করেছে তার ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলি এই অধিকার অনুযায়ী পেটেন্ট , কপিরাইট , ট্রেডমার্ক , ব্যবসায়িক গোপনীয়তার সুরক্ষা প্রভৃতি বিষয়গুলি কতটা নিজেদের এক্তিয়ারে সংরক্ষিত রাখতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তাছাড়া এসব ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতাতেও তারা টিকে থাকতে পারছে না।
৩. কর্পোরেট বিশ্বে বহুজাতিক সংস্থার ( MNC ) আধিপত্য :-
বিশ্বায়নের ফলে বাণিজ্য সম্পর্কিত বিনিয়োগ ব্যবস্থা ( Trade Related Investment Measures or TRIMS ) গৃহীত হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থা বা কর্পোরেট বিশ্বের আধিপত্য সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে এই ব্যবস্থা অনুযায়ী এমন কতগুলি বিধান পালন করতে হয় যার ফলে বহুজাতিক সংস্থাগুলি তাদের কর্তৃত্ব বিস্তারের সুযোগ লাভ করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে , বহুজাতিক সংস্থাগুলি উন্নত দেশসমূহের অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের বৃহত্তম বহুজাতিক সংস্থাগুলির মধ্যে ৬১% মার্কিনি সংস্থা , ৩৩% ইউরোপীয় সংস্থা , ২% জাপানি সংস্থা। সারা বিশ্ব জুড়ে এই বৃহত্তম বহুজাতিক সংস্থাগুলি উন্নয়নশীল দেশসমূহের ক্ষুদ্র সংস্থাগুলিকে অধিগ্রহণ বা সংযুক্তির মাধ্যমে দখল করে নিয়ে তাদের আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছে।
৪. নয়া ঔপনিবেশিক অর্থনীতি :-
বিশ্বায়নের ফলে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা উন্নত ও ধনী দেশগুলির কুক্ষিগত হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নয়া ঔপনিবেশিক অর্থনীতির উদ্ভব ঘটেছে। উন্নত দেশগুলি উন্নয়নশীল বিশ্বের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণে সম্পূর্ণ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। এর ফলে ধনী দেশগুলি কর্তৃক দরিদ্র দেশগুলির শোষণ অব্যাহত রয়েছে।
৫. উত্তর - দক্ষিণ সংঘাত :-
উন্নত দেশসমূহের কর্তৃত্বাধীন বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা যেভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলির ওপর শ্রমখরচ সংক্রান্ত বিধান , অভিন্ন শ্রমিক স্বার্থ সম্পর্কিত নীতি গ্রহণ , কৃষি ক্ষেত্রে ভর্তুকি কমানো প্রভৃতি বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করে চলেছে ; তার ফলে উত্তর ( উন্নত ) বনাম দক্ষিণ ( উন্নয়নশীল ) সংঘাত দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ মোগেনস বুখ হানসেনের মতে , বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা নির্দেশিত উদার অর্থনৈতিক পথে চলতে গিয়ে ধনী বিশ্ব আরও ধনী হচ্ছে এবং অন্যদিকে দরিদ্র বিশ্ব দরিদ্রতর হচ্ছে।
৬. কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসের ফলাফল :-
আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার , বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নির্দেশে উন্নয়নশীল দেশসমূহ যে কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসে হাত দেয় , তার ফলে ব্যাপকভাবে কর্মী সংকোচন , ছাঁটাই , যে অফ , লক আউট , রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বিলগ্নিকরণ , জাতীয় আয়ের সংকোচন - ইত্যাদি প্রক্রিয়া চলতে থাকে। কাঠামোগত এই পুনর্বিন্যাসের ফলে - বেকারত্ব , দারিদ্র্য , আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা - প্রভৃতি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন সমাজের অনগ্রসর ও দুর্বল শ্রেণীর মানুষরা।
৭. সাংস্কৃতিক সমতার প্রভাব :-
বিশ্বায়নের ফলে সারা বিশ্ব জুড়ে সাংস্কৃতিক সমতা তৈরির চেষ্টা চলছে। ইন্টারনেটসহ অত্যাধুনিক গণমাধমের সহায়তায় এক পণ্যমুগ্ধ ভোগবাদী সংস্কৃতির নিরন্তর প্রচারের ফলে আঞ্চলিক ও জাতীয় সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য ক্ষুন্ন হতে বসেছে। বিশ্বায়ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমূহকে এক ছাঁচে ঢেলে এক ধরণের সাংস্কৃতিক সমতা চাপিয়ে দিতে চায়। অনেকে একে মার্কিনি ম্যাকডোনাল্ড সংস্কৃতি বলে আখ্যা দিয়েছেন। এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের বৈচিত্রপূর্ণ বহুমুখী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে।
৮. জাতি - রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের সংকট :-
বিশ্বায়নের প্রভাবে জাতি - রাষ্ট্র ( Nation State ) এর সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব তার নির্দিষ্ট ভূখন্ডের মধ্যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ ও নাগরিকবৃন্দের ওপর চূড়ান্তভাবে প্রযোজ্য হয়। বিশ্বায়ন জাতি রাষ্ট্রের এই ভুখন্ডকেন্দ্রিক সর্বব্যাপী ক্ষমতাকে খর্ব করে রাষ্ট্রকে একটি বাজারকেন্দ্রিক সংগঠনে পরিণত করেছে বলে মনে করা হয়। বস্তুতঃ বিশ্বায়নের পটভূমিকায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলি রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে কাজ করার সুযোগ লাভ করেছে।
৯. পরিবেশদূষণের ব্যাপক প্রসার :-
বিশ্বায়নের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে , বিশেষতঃ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে বহুজাতিক সংস্থাগুলির যেসব শিল্প ও কলকারখানা গড়ে উঠেছে , সেগুলির মধ্যে বেশ কিছুকে পরিবেশ দূষণকারী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এইসব শিল্পের মধ্যে জৈব রসায়ন জাতীয় শিল্পের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উন্নত দেশগুলিতে পরিবেশ রক্ষার আইন কঠোরভাবে মেনে চলা হয় বলে বহুজাতিক সংস্থাগুলি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে পরিবেশদূষণকারী শিল্প গড়ে তোলার কাজে বিশেষভাবে যত্নবান হয়েছে।
উপসংহার :-
বিশ্বায়ন কোনো নতুন ধারণা নয়। বিশ্বায়ন একটি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া যা বহু পূর্বেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বজায় ছিল। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে নতুনভাবে প্রয়োগের কাজ গত শতাব্দীতে , বিশেষত ১৯৯০ এর পর শুরু হয়। রোল্যান্ড রবার্টসন - এর মতে বিশ্বায়ন এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা ( New World Order ) প্রসারের ধারণার সঙ্গে জড়িত। পুঁজির অবাধ চলাচল , মুক্তবাজার অর্থনীতি , উদারীকরণ ও বেসরকারিকরণ প্রভৃতি ধারণার সঙ্গে বিশ্বায়ন ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত।
সীমাবদ্ধতা :-
বিশ্বায়ন বিষয়ক প্রতিবেদনমূলক প্রকল্পটি রূপায়ণের সময়কালে ও রূপায়িত হওয়ার পর যেসকল ত্রুটি - বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতা দৃষ্টিগোচর হয়েছে , সেগুলি হল -
প্রথমতঃ প্রকল্প রচনার সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিশ্বায়নের মত একটি ব্যাপক ও বহুমুখী বিষয়কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা সম্ভব হয়নি।
দ্বিতীয়তঃ বিশ্বায়নের ফলে বর্তমানকালে রাষ্ট্রীয় সর্বভৌমিকতার প্রকৃতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। প্রতিবেদনে এই বিষয়টি সম্পর্কে আলোচনা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত।
তৃতীয়তঃ ভারতীয় গ্রামীণ সমাজে বিশেষ করে কৃষি ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রভাব সম্পর্কেও আলোচনা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত।
চতুর্থতঃ বিশ্বায়ন ও ভোগবাদের সম্পর্কে প্রতিবেদনে আলোচনা অনুপস্থিত।
পঞ্চমতঃ বিশ্বায়ন সম্পর্কে শিক্ষক / শিক্ষিকাদের অভিমত গ্রহণ করা উচিত ছিল।
ষষ্টতঃ বিশ্বায়ন সম্পর্কে প্রতিবেদন রচনা করার পূর্বে আরো তথ্য সংগ্রহ ও গবেষণা প্রয়োজন ছিল।
গ্রন্থপঞ্জি :-
তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে যেসকল গ্রন্থের অনুসরণ করা হয়েছে , সেগুলি হল -
১. ভারত ও বিশ্বের ইতিহাস - জীবন মুখোপাধ্যায় ও সুভাষ বিশ্বাস।
২. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক - প্রণব কুমার দালাল।
৩. ভারতীয় সমাজ - অনাদিকুমার মহাপাত্র।
৪. উচ্চমাধ্যমিক সমাজতত্ত্ব ( দ্বাদশ ) - অরুনাংশু প্রধান।
৫. ভারতীয় সামাজিক সমস্যা - বাণী প্রকাশন।
2 comments
সিদ্ধান্ত পয়েন্ট টা দিলে খুব ভালো হয় এখানে লেখা নেই
ReplyDeleteEducation project প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলির ধরন ও পাঠক্রমের পর্যালোচনা ( তোমার এলাকাভুক্ত যেকোনো দুটি সনেট বিদ্যালয়) এটা দিলে ভালো হতো
Delete