T-20 , IPL এর প্রতি বর্তমান যুবসমাজের আসক্তি ও উন্মাদনা : একটি সমীক্ষামূলক সমাজতাত্ত্বিক পর্যালোচনা :-
T-20 , IPL এর প্রতি বর্তমান যুবসমাজের আসক্তি ও উন্মাদনা : একটি সমীক্ষামূলক সমাজতাত্ত্বিক পর্যালোচনা :-
H.S. Sociology Project
উচ্চমাধ্যমিক সমাজতত্ত্ব প্রকল্প : T-20 , IPL এর প্রতি বর্তমান যুবসমাজের আসক্তি ও উন্মাদনা :
উচ্চমাধ্যমিক সমাজতত্ত্ব প্রকল্প : T-20 , IPL এর প্রতি বর্তমান যুবসমাজের আসক্তি ও উন্মাদনা :
প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্লেষণ করলে বলা যায় যে , বর্তমান জাতীয় যুবসমাজের T-20 বা IPL ইত্যাদি মনোরঞ্জনমূলক ক্রীড়া অনুষ্ঠানগুলির প্রতি আগ্রহ ও মোহ বর্তমান সময়ে মাত্রারিক্ত রূপ নিয়েছে। বর্তমান সমীক্ষামূলক প্রকল্প কর্মটিতে যুবসমাজের T-20 বা IPL এর প্রতি আসক্তি , তার কারণ , বিভিন্ন সমাজতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা - ইত্যাদির উপর আলোকপাত করা হয়েছে। নীচে প্রাপ্ত তথ্যগুলিকে সমাজতাত্ত্বিক আলোকে বিশ্লেষণ করা হল।
১. সমীক্ষায় অংশগ্রহনকারী ব্যক্তিবর্গের প্রত্যেকেরই একটি IPL ম্যাচ দেখতে তিন থেকে চার হাজার টাকা খরচ হয়েছে এবং বলাই বাহুল্য যেহেতু এরা প্রত্যেকেই ছাত্র , তাই টিকিটের টাকাটা তাদের নিজেদের উপার্জিত নয় ; তারা অভিভাবকদের উপরেই সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। উপরন্তু , টিকিটের দাম ছাড়াও , যাতায়াতের খরচ , থাকা ও খাওয়ার খরচ - ইত্যাদি মিলিয়ে আরো দুই - তিন হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
২. শুধুমাত্র একটি ক্রিকেট ম্যাচ দেখার জন্য এত বিপুল পরিমান টাকা খরচের সঠিক কারণ সম্পর্কে তারা নিজেরাই ওয়াকিবহাল নয়। এ সম্পর্কে কথা বলার সময় তাদের মধ্যে দৃঢ়তা ও প্রত্যয় দেখা যায়নি। এটি বর্তমান যুবসমাজের অবক্ষয়ের চরিত্র কি'না তা গবেষণা ও বিতর্কের বিষয় ; কিন্তু একটি ম্যাচ দেখার জন্য যুবসমাজের মধ্যে এমন ব্যাকুলতা সমাজের একটি পপুলার কালচারের দিকে ইঙ্গিত করছে। এই ধরণের পপুলার কালচারের সঙ্গে যুক্ত থাকে মনোরঞ্জন , সামাজিক মাধ্যমে ম্যাচ দেখার ছবি ছেড়ে ভার্চুয়াল দুনিয়ায় নিজের প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা - ইত্যাদি।
৩. স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখার মজাটাই আলাদা - এমনটাই জানিয়েছে সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক যুবক। তবে একটু গভীর ভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখার প্রতি ভালোলাগার মূল কারণ অন্য কোথাও লুকিয়ে আছে ; তার মধ্যে প্রধান দুটি কারণ হল হুল্লোড় ও উন্মাদনা। এই ঘটনাগুলি প্রমান করে , বর্তমান যুবসমাজ উন্মাদনাপূর্ণ , রোমাঞ্চকর পরিস্থিতির প্রতি অধিক পরিমানে আকৃষ্ট - যা বর্তমানে একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।
৪. বর্তমান যুবসমাজের কাছে খেলা ও বিনোদন মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। খেলার সঙ্গে মিশে থাকে মূল্যবোধ , সৌভাতৃত্ত্ব , প্রতিযোগিতার মানসিকতা , দৃঢ়তা , দক্ষতা - ইত্যাদি। কিন্তু IPL বা T-20 তে খেলার সঙ্গে বিনোদনকে মিশিয়ে দেওয়ার পর থেকে উক্ত মূল্যমানযুক্ত প্রত্যয়গুলির প্রয়োজন ফুরিয়েছে। বর্তমানে খেলোয়াড়রা যেন ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে। প্রত্যেক বলে যেন ওভার - বাউন্ডারি চাই। তাই খেলার সঙ্গে যুক্ত ক্রীড়াসুলভ মানসিকতাগুলি দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। সামাজিকভাবে দেখা যাচ্ছে বর্তমান যুবসমাজ খেলায় অংশগ্রহণের পরিবর্তে খেলার উন্মাদনা গ্রহণে অধিক উৎসাহী।
৫. সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী প্রতিটি যুবক কেউই রোজগেরে নয় ; তারা প্রত্যেকেই তাদের অভিভাবকের টাকায় খেলা দেখেছে। আবার এদের মধ্যে বেশিরভাগ অভিভাবকদের মিথ্যে বলে টাকাটা জোগাড় করেছে। কেউ বলেছে কমপিউটার কোর্সের জন্য টাকা চাই , কেউ বলেছে কলেজের ফিসের জন্য টাকা চাই - একেকজনের অজুহাত একেক রকম। এই সামান্য ঘটনাটিকে বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষাপটে আলোচনা করা যেতে পারে। বর্তমান যুবসমাজ বাড়ি থেকে মিথ্যে কথা বলে প্রচুর টাকা খরচ করে শুধুমাত্র হুল্লোড় ও উন্মাদনা ক্রয় করে যাচ্ছে - যা একটি সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিফলন।
৬. চার থেকে ছয় হাজার টাকায় একটি কমপিউটার কোর্স করা যেত বা কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য প্রচুর বই কিনে নেওয়া যেতে পারত ; বা টাকাটা ভবিষ্যতের পড়াশোনার জন্য সঞ্চয় করে রাখা যেতে পারত - কিন্তু বর্তমান যুবসমাজ এসব নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয়। তাদের কাছে এসবের তুলনায় অনেক বেশি উত্তেজনাপূর্ণ স্টেডিয়ামে বসে একটি খেলা দেখা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
৭. যারা এতগুলো টাকা খরচ করে শুধুমাত্র একটি ম্যাচ দেখেছে , তারা কেউই সমাজের উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্য নয়। অথচ তারা শুধুমাত্র একটি খেলা দেখার জন্য কষ্টার্জিত টাকাগুলি খরচ করেছে। এই ঘটনার একটি গভীর সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে। সামাজিকভাবে একটি কলেজ পড়ুয়া ছাত্র এখনো বুঝতে পারেনি তারা জীবনযুদ্ধের দোরগোড়ায় এসে পৌঁচেছে। সংগ্রামশীল ভবিষ্যত জীবনকে উপেক্ষা করে উন্মাদনার চোরা স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়া - যেন বর্তমান যুবসমাজের একটি রীতি হয়ে পড়েছে।
৮. একটি ম্যাচ দেখার জন্য প্রত্যেকের প্রায় ছয় - সাত হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এই টাকা দিয়ে অনেকগুলি পাঠ্যপুস্তক কিনে নেওয়া যেতে পারত। কিন্তু সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী যুবকেরা এবিষয়ে উত্তর দিয়েছে - পড়াশোনার ক্ষেত্রে অধিক মনোযোগের পক্ষপাতী তারা নয় ; তাই বই কেনার প্রস্তাবটা তারা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উড়িয়ে দিয়েছে। সামাজিকভাবে বর্তমান যুবসমাজ বইয়ের পরিবর্তে হুল্লোড় ও উন্মাদনাকে অধিক প্রশ্রয় দিচ্ছে - যার সুদূরপ্রসারী দেখা যাবে এবং সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হবে।
৯. সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী যুবকেরা একবাক্যে স্বীকার স্বীকার করেছে যে যতটা টাকা তারা একটি ম্যাচ দেখার জন্য ব্যয় করেছে - তাতে তারা সন্তুষ্ট নয়। তাদের মতে , যত পরিমান টাকা তারা ব্যয় করেছে , সমপরিমাণ উন্মাদনা তারা লাভ করতে পারেনি। সমাজতাত্ত্বিক দিক দিয়ে বলা যেতে পারে যে ঘটনাটি ভোগবাদের অপর এক প্রকাশ। মানুষ টাকা খরচ করে অপ্রয়োজনীয় ভোগ্য বস্তুকে হস্তগত করার তাগিদে মরীচিকার পেছনে ছুটছে।
0 comments