dramatisation of a bengali story '' chuti '' ( ছুটি গল্পের নাট্যরূপ। )

by - November 16, 2021

ছুটি গল্পের নাট্যরূপ। 

উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রকল্প : গল্পের নাট্যরূপ। 





মূলগল্প : ছুটি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 

চরিত্রবর্গ :- 

ফটিক : ১২ / ১৩ বছর বয়সের একটি ছেলে। 
মাখন : ফটিকের ভাই। 
ফটিকের বন্ধুরা। 
ফটিকের মা। 
বাঘা বাগদি। 
ফটিকের মামা বিশ্বম্ভরবাবু। 
ফটিকের মামী। 
ফটিকের তিন মামাতো ভাই। 
দুজন পুলিশ। 


প্রথম দৃশ্য :- 

মঞ্চটিকে চিত্র , ক্যানভাস ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে এমনভাবে সাজাতে হবে যেন মনে হয় স্থানটি একটি নদী - তীরবর্তী স্থান। মঞ্চে অবশ্যই কিছু পাতাসহ গাছের ডাল , কাশের গাছ - ইত্যাদি উপস্থিত করতে হবে - দৃশ্যটিকে বিশ্বাসযোগ্য ও প্রাঞ্জল করে তোলার জন্য। মঞ্চের মাঝে একটি গাছের গুড়ি থাকবে। সত্যিকারের গাছের গুড়ি জোগাড় করা সম্ভব না হলে থার্মোকল বা অন্য কোনো উপাদান দিয়ে একটি গাছের গুড়ি তৈরী করে নিতে হবে। 

পর্দা উঠলেই দেখা যাবে জনা কয়েক বালক মঞ্চে ইতস্ততঃ ছড়িয়ে - ছিটিয়ে বসে আছে। 

জনৈক বালক : অনেকটা সময় অতিবাহিত হল ; কিন্তু খেলার জন্য কোনো নতুন উপকরণ বা নতুন কোনো খেলার চিন্তা - কিছুই যেন মাথায় আসছে না। ........ বালক সর্দার ফটিক , তুমি কী বল ? কী খেলবো আজকে আমরা ! 

ফটিক ( একটু ভেবে ) : আমার মাথায় নতুন একটা পরিকল্পনা এসেছে। ..........

বালকবৃন্দ ( সকলে উৎসাহিত হয়ে ) : নতুন পরিকল্পনা ! ............ নতুন খেলা ! ...... কী বল , কী বল। ....

ফটিক ( সামনের কাঠের গুড়িটির দিকে নির্দেশ করে ) : আজকে একটি নতুন খেলা খেলি। ঐ যে সামনের কাঠের গুড়িটা দেখতে পাচ্ছো , চলো সেটাকেই আমরা কোথাও গড়িয়ে নিয়ে যাই। 

জনৈক বালক : তাহলে তো যে ব্যক্তির কাঠ প্রয়োজন , তার অসুবিধা বোধ হবে ! 

ফটিক ( দ্বিগুন উৎসাহিত হয়ে ) : আরে তার সেই অসুবিধাটা দেখেই তো আমরা আনন্দ পাবো। 

জনৈক বালক : বাহ্ , দারুন প্রস্তাব , তাহলে তাই হোক। 

সকলে : তাই হোক। ...... তাই হোক। ........

[ এমন সময় ফটিকের ছোটভাই মাখনলাল , যে এতক্ষন চুপ করে বসেছিল , সে হঠাৎ উঠে গিয়ে কাঠের গুড়িটির উপর গিয়ে বসলো। সকলে সেটা দেখে অবাক হয়ে গেল। ] 

জনৈক বালক : এই মাখন কী করছিস ! ওটাতে বসলি কেন ? ওটাকেই তো আমরা এখন গড়িয়ে গড়িয়ে অন্যত্র নিয়ে যাবো। এটাই তো আজকে আমাদের খেলা ! এই মাখন ওঠ , কী করছিস ওটাতে তুই ! 

মাখন ( ভাবুক হয়ে ) : আমি মানব সৃষ্ট সকল প্রকার ক্রীড়ার অসারতা সম্পর্কে নীরবে চিন্তা করছি। 

জনৈক বালক ( অবাক ) : কী বললি তুই ! ......... মানব সৃষ্ট সকল  .......... কী যেন  ....... কিনা কি  ....... ওঠ তো এটা থেকে। 

[ মাখনলালকে আরো দু - একজন বালক কাঠের গুড়ি থেকে ওঠানোর চেষ্টা করলো ; কিন্তু মাখন আরো ভালোকরে কাঠের গুড়ির ওপর নিজের অবস্থান পাকা করে বসলো। ]

ফটিক ( আস্ফালন করে মাখনের সামনে এসে ) : দেখ , মার খাবি। এইবেলা ওঠ। 

[ কিন্তু এতেও মাখনলালের স্থান পরিবর্তনের কোনো উপক্রম দেখা গেল না। ]

ফটিক : এখন আমি বালক সর্দার হিসেবে নিজের রাজসন্মান রক্ষার্থে তোর গন্ডদেশে একটি চর কষিয়ে দিতে পারি ; কিন্তু করবো না  ........... ইচ্ছা করলেই আমি তোকে শাসন করতে পারি  ....... কিন্তু করবো না  ........
[ সকলে ফটিকের মুখের দিকে তাকিয়ে ] 
কেননা এই মুহূর্তে আমার মাথায় পূর্বাপেক্ষা আরও একটি ভালো খেলার পরিকল্পনার উদয় হয়েছে। তাতে আরো একটু বেশি মজা আছে। 

জনৈক বালক : কিন্তু বালক সর্দার ফটিক , কী সেই নতুন খেলা ? 

ফটিক ( সকলের দিকে একটু তাকিয়ে ; একটু রহস্যময় উত্তেজনা তৈরী করে ) : মাখনকে সুদ্ধ এই গুড়ি গড়াতে আরম্ভ করি। 

[ বালকেরা কোমর বেঁধে খেলার জন্য প্রস্তুত হল। কিন্তু মাখন এখনও কাঠের গুড়ির ওপর নির্বিকার চিত্তে বসে থাকলো। ] 

বালকেরা ( সকলে ) : মারে ঠেলা হেঁইয়ো , সাবাস জওয়ান হেঁইয়ো  ...........

[ কিন্তু কাঠের গুড়ি একটু গড়াতেই মাখন ভূমিসাৎ হয়ে গেল। বালকেরা অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে উঠলো। কিন্তু ফটিক যেন একটু ভয় পেল। সে শশব্যস্ত হয়ে মাখনকে তুলে ধরতে গেল। মাখন প্রচন্ড রাগে ক্ষুব্ধ হয়ে নিজেই গা - ঝাড়া দিয়ে উঠলো। উঠেই সে প্রচন্ড রাগে ফটিকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। তাকে অন্ধভাবে মারতে থাকলো। তার নাকে - মুখে আঁচড় কেটে দিল এবং শেষে কাঁদতে কাঁদতে মঞ্চ ত্যাগ করলো। 
ফটিক এই ঘটনায় প্রচন্ড ভয় ও আশ্চর্য হওয়ার সংমিশ্রিত অভিব্যক্তি সহ পাশ থেকে গোটাকতক কাশ উৎপাটন করে সেই কাঠের গুড়ির ওপর বসেই চিবোতে থাকলো। 
ঠিক এমন সময় এক অর্ধবয়সী আগন্তুক ভদ্রলোক মঞ্চে প্রবেশ করলেন। তিনি বালকদের দিকেই এগিয়ে গেলেন। ] 

আগন্তুক : আচ্ছা  ........ এই যে তোমরা  ...... ( সকল বালক আগন্তুক ভদ্রলোকের দিকে তাকালো ) ....... চক্রবর্তীদের বাড়ি কোথায় বলতে পারো ? 

[ সকলে ফটিকের দিকে তাকালো। ফটিক সকলের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো - সকলে তার দিকেই তাকিয়ে আছে , সুতরাং উত্তরটা তাকেই দিতে হবে। ] 

ফটিক ( অনির্দিষ্ট পথনির্দেশ করে ) : ওই যে হোথা। 

আগন্তুক ( অবাক হয়ে ফটিকের পথনির্দেশের দিকে তাকিয়ে ) হোথা  .......... কোথা ? 

ফটিক ( বিরক্ত হয়ে ) : জানি না। 

[ বলেই ফটিক পূর্বের মত কাশের তৃণ চিবোতে থাকলো। আগন্তুক ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে যেদিক দিয়ে মঞ্চে প্রবেশ করেছিলেন তার উল্টো দিক দিয়ে মঞ্চ থেকে প্রস্থান করলেন। এমন সময় বাঘা বাগদি মঞ্চে প্রবেশ করলো। বাঘা বাগদি সরাসরি ফটিকের দিকে এগিয়ে গেল। ] 

বাঘা বাগদি : ফটিকদাদা , মা ডাকছে। 

ফটিক ( উদাসীন ) : যাব না। 

বাঘা বাগদি : যাবে না  ............ ! 

[ এই বলে বাঘা বাগদি ফটিককে বলপূর্বক আড়কোলা করে তুলে নিল। অন্যান্য বালকেরা ভয় পেয়ে মঞ্চ থেকে প্রস্থানের জন্য উদ্যত হল। ফটিক নিষ্ফল আক্রোশে হাত - পা ছুঁড়তে লাগলো। বাঘা বাগদি সেই অবস্থাতেই ফটিককে নিয়ে মঞ্চ থেকে প্রস্থান করলো। ] 

দ্বিতীয় দৃশ্য  :- 

মঞ্চ পরিকল্পনা :- প্রথম দৃশ্যের মঞ্চসজ্জার উপাদানগুলি এখানে কিছুই উপস্থিত থাকবে না। দৃশ্যটিতে একটি সাধারণ গৃহস্থের দালানকে ফুটিয়ে তুলতে হবে। 

[ দৃশ্যের শুরুতেই বাঘা বাগদি ফটিককে নিয়ে যে অবস্থায় প্রথম দৃশ্যে মঞ্চ থেকে প্রস্থান করেছিল ঠিক সেই একইভাবে বাঘা বাগদি ফটিককে আড়কোলা করে তুলে মঞ্চে প্রবেশ করলো। ফটিক এখনও নিষ্ফল আক্রোশে হাত - পা ছুড়ছে। মঞ্চে প্রবেশ করে বাঘা বাগদি ফটিককে মঞ্চে দাঁড় করালো ; কিন্তু তাকে শক্ত করে ধরে থাকলো। ] 



বাঘা বাগদি : মা , ফটিককে নিয়ে এসেছি , মা  ......... 

[ মঞ্চে ফটিকের মা অগ্নিমূর্তি হয়ে প্রবেশ করলেন। সোজা ফটিকের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন। ]     

ফটিকের মা : আবার তুই মাখনকে মেরেছিস ? 

ফটিক : না , মারি নি। 

ফটিকের মা : ফের মিথ্যে কথা বলছিস ! 

ফটিক : না , কক্ষনও মারি নি , মাখনকে জিজ্ঞাসা করো। 

মাখন ( কারো জিজ্ঞাসার অপেক্ষা না করেই ) হ্যাঁ , মেরেছে। 

[ এই কথা ফটিকের সহ্য হল না। সে দ্রুত গিয়ে মাখনকে এক সশব্দ চড় কষিয়ে দিল। ] 

ফটিক ( চড় মারার পর ) : ফের মিথ্যে কথা ! 

[ ফটিকের মা এ দৃশ্য দেখে প্রচন্ড রেগে যান। ফটিককে সবেগে নাড়া দিয়ে তার পিঠে প্রবল কয়েকটা চপেটাঘাত করলেন। ফটিক এই সময় মাকে একটু ঠেলে দেয়। মা তাতে আরও অগ্নিমূর্তি ধারণ করেন। ] 

ফটিকের মা : কি ! ...... তুই আমার গায়ে হাত তুলিস ! 

[ ঠিক এই সময় প্রথম দৃশ্যের সেই  আগন্তুক ভদ্রলোক মঞ্চে প্রবেশ করলেন। মঞ্চে প্রবেশ করেই ফটিক ও তার মায়ের রাগারাগির দৃশ্য তার চোখে পড়ে। ] 

আগন্তুক ভদ্রলোক : কী হচ্ছে তোমাদের ! 

[ ফটিকের মা আগন্তুক ভদ্রলোককে দেখে আনন্দে অভিভূত হয়ে পড়েন। তার দিকে এগিয়ে যান। ] 

ফটিকের মা : ওমা  ....... এ যে দাদা , তুমি কবে এলে ? 
[ বলেই গড় হয়ে ফটিকের মা আগন্তুক ভদ্রলোককে প্রণাম করলেন। ] 

আগন্তুক ভদ্রলোক : আসতে পারি নি রে , আসতে পারি নি  ............ তোর বিয়ের পর সেই যে পশ্চিমে কাজ করতে গেলাম  ........... আর এই এলাম। তা এর মধ্যে তোর দুটি ছেলে হয়েছে , সে সংবাদ পেয়েছি। তা কোথায় তোর গুণধর পুত্রদুটি ? 

ফটিকের মা ( ফটিকের দিকে ইঙ্গিত করে ) : তার মধ্যে তো একটি তোমার সামনেই আছে দাদা  ...... এই হল ফটিক  ............ আমার হাড় মাস সব জ্বালিয়ে খেল। বড় জ্বালাতন করছে ছেলেটা। 

আগন্তুক ( বিশ্বম্ভরবাবু ) : তা তুমি সেই না , যার সাথে নদীর ঘাটে দেখা হয়েছিল  ........... ( চিনতে পারার পর ) .......... এর সাথে তো আমার আগেই সাক্ষাৎ হয়েছে  .......... ( এই বলে হাসতে থাকলেন ) 

তৃতীয় দৃশ্য :- 

মঞ্চসজ্জা দ্বিতীয় দৃশ্যের অনুরূপ। 

ফটিকের মা : দাদা , তুমি এতদিন পর এলে  ....... মাত্র ক'টা দিন থাকলে , আর আবার চলে যাচ্ছো। ক'টা দিন আর থেকে গেলে পারতে। 

বিশ্বম্ভরবাবু : উপায় নেই রে , উপায় নেই। 

ফটিকের মা : কিন্তু এই ফটিক বাঁদর যে আমাকে জ্বালিয়ে মারে। তুমি এ কটা দিন ছিলে , তাই এই বাঁদরটা বিশিষ্ট বালকের মত আচরণ করেছে। কিন্তু তুমি চলে গেলেই এর আবার লেজ গজাবে , বাঁদর হয়ে গাছে চড়বে। 

বিশ্বম্ভরবাবু ( একটু ভেবে ) : তা এক কাজ করা যায় , ফটিককে আমি কলকাতায় নিয়ে গিয়ে নিজে কাছে রাখবো , সেখানেই পড়াশোনা করবে ও ; উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করবো। 

ফটিকের মা ( অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে ) : সেই ভালো দাদা , তাহলে ছেলেটা মানুষ হবে। 

বিশ্বম্ভরবাবু ( ফটিককে উদ্দেশ্য করে ) : কি'রে ফটিক , মামার সঙ্গে কলকাতায় যাবে ? 

ফটিক ( আনন্দে লাফিয়ে উঠে ) : যাবো , অবশ্যই যাবো। 

বিশ্বম্ভরবাবু : বাঃ বাঃ সেই ভালো , তুই চল আমার সাথে , এখানে মা'কে অতিষ্ঠ করে মারছিস। 

ফটিক ( অত্যন্ত উদ্দীপনা ও আগ্রহের সাথে ) : কবে যাবে বলো , এক্ষুনি , চলো  ... চলো  ..... ( মাখনের দিকে তাকিয়ে ) যাওয়ার আগে অবশ্য আমার আনন্দের ঔদার্য বশতঃ আমার ছিপ , ঘুড়ি , লাটাই সমস্তই তোকে পুত্রপৌত্রাদিক্রমে ভোগদখল করার পুরো অধিকার দিয়ে গেলাম। 

চতুর্থ দৃশ্য :- 

বিশ্বম্ভরবাবুর বাড়ি ; অর্থাৎ ফটিকের মামার বাড়ি। ছিমছাম , সাজানো গোছানো আসবাবপত্রে পরিপূর্ণ। ফটিকের মামী একটি চেয়ার বা সোফায় উপবেষ্টিতা। এমন সময় বিশ্বম্ভরবাবু ফটিকের সাথে বাক্স ইত্যাদি নিয়ে মঞ্চে প্রবেশ করলেন। 

বিশ্বম্ভরবাবু ( স্ত্রীকে ) : এই দেখো , কাকে সাথে করে এনেছি  ....... আমার ভাগ্নে ফটিক। 

[ ফটিক এগিয়ে গিয়ে মামীকে প্রণাম করলো। মামী কিছুটা বিরক্ত। ] 

বিশ্বম্ভরবাবু ( স্ত্রী বিরক্ত বুঝতে পেরে , ফটিককে উদ্দেশ্য করে ) : আচ্ছা ফটিক , তুমি পাশের ঘরে একটু জিরিয়ে নাও। 

[ একথা শুনে ফটিক মঞ্চ থেকে প্রস্থান করলো। ] 

বিশ্বম্ভরবাবুর স্ত্রী : এ এখন থেকে এখানেই থাকবে ? 

বিশ্বম্ভরবাবু ( ইতস্ততঃ করে ) : হ্যাঁ , সেরকমই তো ভেবেছি  ....... 

বিশ্বম্ভরবাবুর স্ত্রী ( আরো বেশি বিরক্ত হয়ে ) : আমার তিন তিনটি ছেলে নিয়ে আমি নিজেই হিমশিম খাচ্ছি , তার মধ্যে এই অপরিচিত , অশিক্ষিত , পাড়াগেঁয়ে একটা  ছেলে এখানে থাকবে ? বলি তোমার এত বয়স হল , কোনো কান্ডজ্ঞান আছে ! 

পঞ্চম দৃশ্য :- 

বিশ্বম্ভরবাবু এবং তাঁর স্ত্রী মঞ্চে উপবিষ্ট। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে তাদের তিন ছেলে ( পরনে স্কুলের পোশাক , কাঁধে বইয়ের ব্যাগ ) মঞ্চে প্রবেশ করলো। 

বিশ্বম্ভরবাবুর ছেলে ১ : বাবা , আমরা আর কোনোদিন ফটিককে নিয়ে স্কুলে যাবো না। 

বিশ্বম্ভরবাবু : কেন , কী হল আবার ? 

বিশ্বম্ভরবাবুর ছেলে ২ : ও একদিনও পড়া পারেনা। মাস্টারমশাইয়ের কাছে প্রতিদিন মার খায়। সকলে ওকে গেঁয়ো ভূত বলে। 

[ তাদের কথাবার্তা চলতে চলতে ফটিক বিধ্বস্ত অবস্থায় মঞ্চে প্রবেশ করে। ] 

বিশ্বম্ভরবাবু ( ফটিককে দেখতে পেয়ে ) : কেন রে ফটিক , একদিনও পড়া পারিস না কেন ? 

[ ফটিক মাথা নীচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ] 

বিশ্বম্ভরবাবুর ছেলে ৩ : পড়া তো পরেই না , এমনকি মাস্টারমশাই বোর্ডে অংক কষিয়ে দিলে তা দেখে খাতায় টুকতেও পারেনা ; সবসময় যেন অন্যমনস্ক হয়ে থাকে। 

বিশ্বম্ভরবাবু ( রাগত ভাবে ফটিকের দিকে তাকিয়ে ) : কেন রে ফটিক ? ব্যাপারটা কী ? 

ফটিক ( অত্যন্ত আড়ষ্টভাবে ) : মামাবাবু , আমি বই হারিয়ে ফেলেছি। 

[ এই কথা শুনে ফটিকের মামী অত্যন্ত রেগে যান। ] 

বিশ্বম্ভরবাবুর স্ত্রী : তোমাকে মাসে পাঁচবার বই কিনে দেবার সামর্থ্য আমাদের নেই। 

[ বলেই তিনি উঠে পড়েন এবং মঞ্চ পরিত্যাগ করেন। ফটিকের মামাতো ভাইয়েরাও অত্যন্ত বিরক্ত মুখে মঞ্চ ত্যাগ করে। ] 

ফটিক ( কাঁদতে কাঁদতে ) : মামাবাবু , আমি মায়ের কাছে যাবো। এখানে আমাকে কেউ পছন্দ করেনা ; সবার কাছে আমি অসহ্যের পাত্র। আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে এখানে। আমি বাড়ি যাবো। 



বিশ্বম্ভরবাবু : আচ্ছা সে দেখা যাবে। কার্তিক মাসে স্কুলের ছুটি হোক , তারপর দেখা যাবে। 

[ আলো নিভে যায়। তার কিছুক্ষন পর আলো আবার জ্বলে উঠলো। বিশ্বম্ভরবাবু এবং তার স্ত্রী মঞ্চে উপবিষ্ট। চেয়ারে বা সোফাতে বসে আছেন। এমন সময় বিশ্বম্ভরবাবুর তিন ছেলে স্কুলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়ে মঞ্চে প্রবেশ করলো। ] 

বিশ্বম্ভরবাবু : কি'রে স্কুলে চললি ? 

বিশ্বম্ভরবাবুর ছেলে ১ : হ্যাঁ বাবা। 

বিশ্বম্ভরবাবু : তা ফটিক যাচ্ছে না আজকে স্কুলে ? তাকে যে দেখছি না ! 

বিশ্বম্ভরবাবুর ছেলে ২ : না বাবা , ওর নাকি জ্বর হয়েছে , শুয়ে আছে। 

বিশ্বম্ভরবাবুর ছেলে ৩ : আর স্কুলে গেলেও তাকে সঙ্গে নিয়ে আমরা স্কুলে যেতাম না। 

বিশ্বম্ভরবাবু : সে'কি ফটিকের জ্বর ! ( চিন্তিত ) 

বিশ্বম্ভরবাবুর স্ত্রী ( প্রচন্ড রেগে গিয়ে ) : জ্বর তো কী ! একদম আদিখ্যেতা দেখাতে যাবেনা বলে দিলাম। জ্বর না ছাই ; নাটক , সব নাটক। কাজ না করার অজুহাত। 

বিশ্বম্ভরবাবু ( অবাক হয়ে ) : কাজ ! ও আবার কী কাজ করে ? 

বিশ্বম্ভরবাবুর স্ত্রী ( থতমত খেয়ে ) : কাজ  ........ এই তো  ..... নিজের কাজ  ...... 

বিশ্বম্ভরবাবু : কিন্তু জ্বর হলে তো ডাক্তারবাবুকে ডাকতে হবে।  

বিশ্বম্ভরবাবুর স্ত্রী : একদম না ; ওর পেছনে টাকা খরচ করার কোনো প্রয়োজন নেই। এ সাধারণ জ্বর , কালকের মধ্যে এমনিই সেরে যাবে। 

বিশ্বম্ভরবাবু ( হতাশ ) : আচ্ছা  ....... বলছো যখন  ....... দেখি। .......

ষষ্ঠ দৃশ্য :- 

বিশ্বম্ভরবাবু মঞ্চে উপবিষ্ট। চেয়ারে বা সোফায় বসে আছেন। তাঁর স্ত্রী মঞ্চে প্রবেশ করলেন। তিনিও বসলেন। 

বিশ্বম্ভরবাবু : তা , ফটিকের জ্বরটা এখন কেমন আছে ? 

বিশ্বম্ভরবাবুর স্ত্রী : আমি কী'করে জানবো ? 

বিশ্বম্ভরবাবু : দেখোনি তুমি ! .......... আচ্ছা রাতে কি ও খেয়েছে ? 

বিশ্বম্ভরবাবুর স্ত্রী : বলতে পারবো না। 

বিশ্বম্ভরবাবু ( রেগে গিয়ে ) : তুমি কাল রাতে ওকে খেতেও দাওনি ! তুমি না ওর মামী ! মাতৃসমা ! ছিঃ ছিঃ ছিঃ , আমি আমার বোনকে মুখ দেখাবো কি করে  ................ তোমাদের জন্যই  ........... 

[ ঠিক এমন সময় বিশ্বম্ভরবাবুর তিন ছেলে দৌড়ে মঞ্চে প্রবেশ করলো। সকলেই হাফাচ্ছে। ] 

বিশ্বম্ভরবাবুর ছেলে ১ : ( হাঁফাতে - হাঁফাতে ) বাবা  ......... বাবা  ........ ফটিককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। 

বিশ্বম্ভরবাবুর ছেলে ২ : আমরা অনেক খুঁজলাম। বাড়ির সর্বত্র খুঁজে দেখেছি ; কিন্তু কোথাও নেই। 

বিশ্বম্ভরবাবুর ছেলে ৩ : বাড়ির আশেপাশেও খুঁজে দেখলাম। 

বিশ্বম্ভরবাবু ( উদ্বিগ্ন হয়ে ) : সে'কি  .......... ছেলেটার জ্বর  ........ চল  .... চল  .... চল  .... আশেপাশে আরেকবার খুঁজি , তারপর থানায় খবর দিতে হবে। 

[ বিশ্বম্ভরবাবু তাঁর তিন পুত্র সহ মঞ্চ থেকে প্রস্থান করলেন। ] 

সপ্তম দৃশ্য : - 

বিশ্বম্ভরবাবু খুব উদ্বিগ্ন হয়ে মঞ্চে পায়চারি করছেন। 

বিশ্বম্ভরবাবু : না  ..... না  ..... না  ...... ছেলেটাকে নিয়ে এসে আমি খুব অন্যায় করেছি।  ...... বুঝতেই পারিনি এমনটা হবে। ভেবেছিলাম ওর মামী মায়ের মত তার খেয়াল রাখবে  ......... আমার ছেলেরা ওর বন্ধু , ভাই হয়ে উঠবে ! কিন্তু হল উল্টোটা। আমি  ..... আমি যদি আগে জানতে পারতাম তাহলে এমনটা হতে দিতাম না। 

[ ঠিক এমন সময় দুজন পুলিশ ফটিককে ধরাধরি করে নিয়ে মঞ্চে প্রবেশ করলো। ফটিক প্রায় অচেতন। মুখে শুধু মা  ......... মা  ..... বলে ডাকছে। পুলিশ দুজন বিশ্বম্ভরবাবুর সামনের সোফায় ফটিককে শুইয়ে দিল। ] 

পুলিশ ১ : এ আপনার কে হয় ? 

বিশ্বম্ভরবাবু : আমার ভাগ্নে। 

পুলিশ ১ : দেখুন , এর মা'কে খবর দিন। ছেলে প্রচন্ড অসুস্থ। আমরা ডাক্তার দেখিয়েছি ; কিন্তু ডাক্তারবাবু এর স্বাস্থ্য বিষয়ে যথেষ্ট চিন্তিত। তাই তাড়াতাড়ি এর মা'কে খবর দিন। 

[ বলেই বিশ্বম্ভরবাবুর উত্তরের অপেক্ষা না করেই দুজন পুলিশ মঞ্চ ত্যাগ করলেন। বিশ্বম্ভরবাবু ধীরে ধীরে ফটিকের দিকে এগিয়ে গেলেন। ] 

ফটিক ( কাতর স্বরে ) : মামা  ......... আমার কি এখনো ছুটি হয়নি ? .......... আমি মায়ের কাছে যাবো  ............ 

বিশ্বম্ভরবাবু : হ্যাঁ , ফটিক তুমি মায়ের কাছে যাবে ; দাঁড়াও আমি এক্ষুনি তোমার মা'কে আনানোর ব্যবস্থা করছি। 

[ এই বলে বিশ্বম্ভরবাবু মঞ্চ ত্যাগ করলেন। ফটিক এখন মঞ্চে একা। সোফায় শুয়ে আছে। ] 

ফটিক ( বিলাপের স্বরে ) : মা  ........... মা  ......... আমাকে মারিস নে মা  ............ সত্যি বলছি আমি কোনো দোষ করিনি  ......... মা  ........ মা  ........ আমি সমুদ্র যাত্রা করছি  ............ ওই যে   ........ স্টীমারের খালাসিরা রশি ফেলে সুর করে জল মাপতো  ......... কিন্তু আমি রশি ফেলেও জলের তল পাচ্ছিনা মা  ............... আমার ছুটি হয়েছে  ............ 

[ আলো নিভে এল এবং কিছুক্ষন পর আবার জ্বলে উঠলো। ফটিক একই ভাবে সোফায় শুয়ে আছে। হঠাৎ ফটিকের মা কাঁদতে কাঁদতে মঞ্চে প্রবেশ করলেন। ফটিকের শয্যার ওপর তিনি আছাড় খেয়ে পড়লেন। ] 

ফটিকের মা : ফটিক সোনা ! মানিক আমার ! 

ফটিক ( কাতর কণ্ঠে ) : মা। ......... 

ফটিকের মা : ওরে ফটিক , বাপধন রে ! 

ফটিক : মা  ......... এখন আমার ছুটি হয়েছে মা  ....... এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি  ....... ।  


[ যবনিকা পতন। ] 


You May Also Like

1 comments