feminist perspective in sociology - project

by - November 11, 2021

H.S. Sociology project : Feminist Perspective in Sociology 



সমাজতত্ত্বে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি :- 


ভূমিকা :- 

সমাজতত্ত্বে নারীবাদের পর্যালোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজতত্ত্বে নারীবাদকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি(perspective) হিসেবে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সত্তর দশকের পূর্বে কিংবা বলা ভালো, সূচনাপূর্ব থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত সমাজতত্ত্ব ছিল প্রধানত একটি পুরুষালি শাস্ত্র, কারণ এই সময় ধ্রুপদী সমাজতত্ত্বে নারীবাদের পর্যালোচনা বা নারীর দৃষ্টিকোণ ছিল সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। 

অন্যদিকে নারীবাদ হল একটি সামাজিক আদর্শ ও আন্দোলন যা লিঙ্গসাম‍্যে আস্থাশীল এবং লিঙ্গবৈষম্যবাদী প্রাধান্য-বশ‍্যতার পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোকে ভেঙ্গে লিঙ্গসাম্য ও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দায়বদ্ধ এবং যা নারীর দৈহিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, যৌনতা-কেন্দ্রিক, ক্ষমতা কেন্দ্রিক আত্ম প্রতিষ্ঠার এক সচেতন, সম্মিলিত প্রয়াস।

‛নারীবাদ’ শব্দটি সম্ভবত ১৮৭১ সালে ফরাসি চিকিৎসা বিজ্ঞানের বইতে সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হয়। এই নারীবাদী চিন্তার উদ্ভবের ক্ষেত্রে যাঁদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁরা হলেন- নাট্যকার আফ্রাবেহন(১৬৪০-১৬৮৯) এবং মেরি অ্যাস্টেল(১৬৬৬-১৭৩১)। নারীবাদী চিন্তার উদ্ভবের ক্ষেত্রে মেরি অ্যাস্টেলের নামও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অ্যাস্টেল সেইসময়ে সনাতনী চিন্তার বিপরীতে গিয়ে নারীদের মা ও ধর্মযাজিকা হওয়া ছাড়াও অন্যকিছু হয়ে উঠার চিন্তা করতে শেখান। পুরুষ ও নারীর সমান সুযোগ প্রদানের কথা তিনি বলেন। ১৭০৬ সালে প্রকাশিত ‘Some Reflections upon Marriage’ গ্রন্থের মুখবন্ধে তিনি মন্তব্য করেন “If all men are born free, how is it that all woman are born slaves”.



যে সকল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রকল্পটি রচনা করা হয়েছে সেগুলি নিম্নরূপ - 
১. সমাজতত্ত্বে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানা। 
২. নারীবাদের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন। 
৩. নারীবাদের উদ্ভবের কারণগুলি পর্যালোচনা করা। 
৪. নারীবাদ সমাজতত্ত্বকে কতটা এবং কীভাবে প্রভাবিত করেছে - তা আলোচনা করা। 
৫. নারীবাদ সম্পর্কে বিভিন্ন দার্শনিক তত্ত্বগুলি তুলে ধরা। 
৬. নারীবাদী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে এবং তাদের কার্যধারা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। 
৭. সর্বোপরি সমাজতত্ত্বে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করে তোলা। 

প্রকল্পের গুরুত্ব :- 

যে সকল কারণে প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতে পারে , সেগুলি হল - 
১. নারীবাদ সম্পর্কে ধারণালাভ করার ক্ষেত্রে প্রকল্পটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 
২. নারীদের যে সকল বিশেষ সামাজিক অবস্থানগুলির কারণে নারীবাদের উদ্ভব ঘটেছে , প্রকল্পটিতে খুব গুরুত্বের সাথে সেই সকল ইতিহাস আলোচনা করা হয়েছে। 
৩. সমাজতত্ত্বে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি কতটা কার্যকর হয়েছে - তা জানতে প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ। 
৪. নারীবাদী আন্দোলন ও নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ফলে বর্তমান সময়ে নারীদের মর্যাদাগত অবস্থার পরিবর্তন সম্পর্কে প্রকল্পটিতে আলোকপাত করা হয়েছে। 
৫. বর্তমান প্রচলিত সমাজবিজ্ঞানগুলিতে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ।  

   

প্রকল্পের বর্ণনা : তথ্য বিশ্লেষণ :- 

নারীবাদী সমাজতত্ত্বের বৈশিষ্ট্য:-

প‍্যাট্রিশিয়া লেঙ্গারম‍্যান ও জিল নিয়েব্রাগ- ব্রান্টলের মতো তাত্ত্বিকরা, ধ্রুপদী সমাজতত্ত্বে নারীবাদী সমাজতাত্ত্বিকদের বেশ কিছু প্রশ্নের অবতারণ করেছেন। তাঁদের মতে, “ধ্রুপদী সমাজতত্ত্বে নির্মিত এই একপেশে সামাজিক বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে নারীবাদী সমাজতাত্ত্বিকদের যে তিনটি তাত্ত্বিক প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা হল, ধ্রুপদী সমাজতত্ত্বে মেয়েরা কোথায় গেল? নারী প্রসঙ্গের এই অনুপস্থিতি কেন? এবং কিভাবে এই একপেশে পিতৃতান্ত্রিক বিশ্বের পরিবর্তন ও উন্নতি করা সম্ভব”?
এই প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজতে গিয়ে নারীবাদী তাত্ত্বিকেরা যে উপলব্ধি করেছেন তা হল, সমাজতত্ত্বে বিশ্লেষিত অভিজ্ঞতাগুলি সবই কেবলমাত্র পুরুষের অভিজ্ঞতা। কেবলমাত্র এই পুরুষদের অভিজ্ঞতার প্রাধান্যর জন্যই নারীবাদী তাত্ত্বিকরা বলেছেন, সমাজতত্ত্বে এই অর্ধেক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যা তৈরি হয়েছে আসলে তা হল ‘অর্ধেক সমাজতত্ত্ব’। নারীবাদী সমাজতত্ত্বের পথপ্রদর্শক ডরোমি স্মিথের পাশাপাশি জেসি বার্নাড ও ন‍্যানসিশোডো, ক‍্যারল গিলিগান, হান্টক, অ্যাড্রিয়েন রিচ প্রমুখ নারীবাদী সমাজতাত্ত্বিকের মিলিত প্রয়াস থেকে যে নারীবাদী সমাজতত্ত্বের বৈশিষ্ট্যগুলির কথা বলা যায় সেগুলি হল-
(১) নারীবাদী দ্বন্দ্বতত্ত্ব যা দ্বান্দ্বিক চিন্তার একটি বিশিষ্ট ভঙ্গি।
(২) নারীবাদী সমাজতত্ত্ব ম‍্যাক্সো-সোশ্যাল অর্ডারের একটি বিশিষ্ট ছাঁচ।
(৩) নারীবাদী সমাজতত্ত্ব মাইক্রো-সোশ্যাল অর্ডারে নারী সম্পর্কিত পরিস্থিতির এমন এক উন্মোচন যা সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সনাতন সমাজতাত্ত্বিক ধারণাগুলিকে পাল্টে দেয়।
(৪) নারীবাদী সমাজতত্ত্ব সমাজতত্ত্বের বিষয়কেন্দ্রিক চিন্তার ছাঁচের একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংশোধন। 

নারীবাদী সমাজতত্ত্বের পর্যালোচনার ভীতকে আরও সুদৃঢ় ভাবে বিশ্লেষণ করতে যে বিষয়গুলিকে বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন তাহল- নারীবাদ কী? নারীবাদের উদ্ভব, ম‍্যারি উলস্টোনক্রাফট ও নারীবাদ, ডরোমি স্মিথ ও নারীবাদ, নারীবাদের বিভিন্ন তরঙ্গ ও ধারা এবং নারীবাদ সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়াবলী।

মেরি উলস্টোনক্র্যাফট ও নারীবাদ:-

নারীবাদের প্রথম প্রবক্তা হিসেব মেরি উলস্টোনক্র্যাফট (১৭৫৯-১৭৯৭) এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর লেখা বিখ্যাত গ্রন্থের নাম হল- ‘A Vindication of the Rights of Woman'(১৭৯২)। তিনিই সর্বপ্রথম নারীর ভোটাধিকার বিষয়টিকে সর্বসমক্ষে তুলে ধরেন। তিনি নারীর শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, নারীরা কেবল পুরুষদের স্ত্রী নয়। একজন নারী বা মা পুরুষের সহকর্মীর পাশাপাশি সন্তানদের প্রাথমিক পরিচর্যা, শিক্ষা এবং দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তাই নারীদের শিক্ষিত হওয়া বিশেষ প্রয়োজন।

তাহলেই রাষ্ট্রের সার্বিক বিকাশ সম্ভব। উলস্টোনক্র্যাফট শিক্ষাক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেছেন, নারীদেরকে সমাজের অলংকার হিসেবে গণ্য না করে সমাজে তাদের উপযুক্ত স্থান দেওয়ার কথা। অর্থাৎ পুরুষদের সঙ্গে নারীবাদের সমান মৌলিক অধিকারের কথা তিনি দাবী করেন। তাঁর মতে ‛নারীর ভোটাধিকার অর্জিত না হলে, গণতন্ত্র কখনও ‛সার্থক’ গণতন্ত্র হয়ে উঠতে পারেনা, তিনি ‛গণপরিসরের’ সঙ্গে সম্পর্করহিত ভাবে নারীর ‛ব্যক্তি পরিসরের’ মধ্যে আবদ্ধ থাকাকে সমালোচনা করেন।

ডরোথি স্মিথ ও নারীবাদ:-

নারীবাদী সমাজতত্ত্বের প্রথম ও প্রধান প্ৰবক্তা হলেন ডরোথি স্মিথ। তাঁর বিখ্যাত একটি গ্রন্থের নাম হল- ‘A Sociology for Woman'(১৯৭৮)। তাঁর মতে, বিশেষ সামাজিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে জ্ঞানের সামাজিক নির্মাণ হয়। এবং পুরুষের তৈরি বাচন বা ‛মেল ক্রিয়েটেড ডিসকোর্স’ নারীর শোষণে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। স্মিথ উপলব্ধি করেন যে, প্রচলিত সমাজ বৈজ্ঞানিক ধারণা ও সমাজ জীবনের প্রকৃত অভিজ্ঞতার মধ্যে অনেক পার্থক্য। বিশেষত, মেয়েদের জীবন-যাপনের বাস্তব অভিজ্ঞতা আর যে পিতৃতান্ত্রিক ছাঁচে তাদের অভিজ্ঞতাকে বর্ণনা করা হয় তার মধ্যে। 



নারীবাদের বিভিন্ন তরঙ্গ ও ধারা:-

নারীবাদের প্রথম তরঙ্গ(First Wave Feminism):-

নারীবাদের প্রথম তরঙ্গ ১৮৪৮ এর সেনেকা ফলস কনভেনশনে শুরু হয়ে বিশ শতকের গোড়ার দিক পর্যন্ত সক্রিয় ছিল। বলা হয়, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত যেসব নারীবাদী চিন্তা, বিশ্লেষণ, তত্ত্ব বা সমান্তরালভাবে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সেগুলোকে সামগ্রিকভাবে নারীবাদের প্রথম তরঙ্গ(First Wave) বলা হয়। এই তরঙ্গের নারীবাদী চিন্তা সমাজে নারী পুরুষের বৈষম্য, নারীর নিম্নতর অবস্থান, নারীর অধিকার অর্জন ইত্যাদি বিষয়গুলির উপর গুরুত্ব দিয়েছিল।

নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গ(Second Wave Feminism):-

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে নারীবাদী আন্দোলনে ও তাত্ত্বিক আলোচনায় আবার এক জোয়ার দেখা যায়। এই সময়ের চিন্তা ভাবনার সূত্রপাত হয় ফরাসি দার্শনিক Simon de Beauvoir এর বিখ্যাত :The Second Sex'(১৯৪৯) গ্রন্থে। এই বইটিতে লেখা বোভোয়ার বক্তব্য নারীবাদী চিন্তায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। এই বইটিতে তিনি যে ব্যাখ্যা দেন তা হল- কেন আইনী সাংবিধানিক সাম্য থাকলেও নারীরা নিম্নতর অবস্থানে থাকে। বোভোয়া বলেন যে, জৈবিক নিয়মানুসারে ছেলে মেয়ের পার্থক্য খুব স্বাভাবিক কিন্তু সামাজিক প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে ছেলের পৌরুষ(Masculinity) তৈরি করে ও মেয়ের নারীত্ব(Femininity) সৃষ্টি করে। এপ্রসঙ্গে বোভোয়া বলেছেন, ‛One is not born but mother becomes, a woman.’
দ্বিতীয় তরঙ্গে বোভোয়ার পাশাপাশি আর একজন নারীবাদী তাত্ত্বিক ছিলেন তিনি হলেন বেটি ফ্রাইডেন। তাঁর লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ হল ‘The Feminine Mystique:(১৯৬৩)। তিনি এই বইতে মূলস্রোতের সংস্কৃতি নারীকে যেভাবে উপস্থাপিত করে তার তীব্র সমালোচনা করেন।

এই দুই প্রকাশনা ১৯৬০ এর দশকে নারীদের যে দ্বিতীয় তরঙ্গ শুরু করে তা ১৯৮০ র দশক পর্যন্ত চলে। প্রথম তরঙ্গের তুলনায় এই তরঙ্গ ছিল অনেকবেশি বৈপ্লবিক ও প্রগতিশীল। গ্রেট ব্রিটেনে দ্বিতীয় তরঙ্গে নারীবাদী আন্দোলন মূলত অর্থনৈতিক বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। শ্রমিক নারীদের সমান মজুরির দাবী, বিভিন্ন কারখানায় ধর্মঘট ইত্যাদি দ্বিতীয় তরঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ। 

নারীবাদের তৃতীয় তরঙ্গ(Third Wave Feminism):-

নারীবাদের তৃতীয় তরঙ্গের সূত্রপাত হয় ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে এবং ধরা হয় এখনও এই পর্যায়টি চলছে। দ্বিতীয় তরঙ্গ একটি সর্বজনীন সারবাদী নারী পরিচিতি তৈরি করতে চেয়েছিল তার জন্য তৃতীয় তরঙ্গের নারীবাদীরা দ্বিতীয় তরঙ্গকে সমালোচনা করেন। তৃতীয় তরঙ্গের নারীবাদ গাত্রবর্ন ভিত্তিক গোষ্ঠীর বিরোধিতা, উত্তর ঔপনিবেশিকতাবাদী তত্ত্ব, সমালোচনামূলক তত্ত্ব, উত্তর আধুনিকতাবাদ, পরিবেশ কেন্দ্রিক নারীবাদ, বিকল্প যৌনতার চিন্তা ইত্যাদি থেকে রসদ সংগ্রহ করে। এই তরঙ্গের একটি উল্লেখযোগ্য ধারণা হল ‛নারীশক্তি’ বা ‛Girl Power’।

এই তরঙ্গের প্রবক্তারা হলেন- রেবেকা ওয়াকার, ইনগার মিউসিও, মনিকা দাভে প্রমুখরা। এই তৃতীয় তরঙ্গেই শুরু হয় উত্তর আধুনিক, উত্তর উপনিবেশবাদী, কৃষ্ণাঙ্গ, নারী সমকামী, মনসমীক্ষনবাদী, উত্তর অবয়ববাদী ও তৃতীয় বিশ্ব কেন্দ্রিক নানা নারীবাদের উত্থান।

নারীবাদের চতুর্থ তরঙ্গ(Fourth Wave Feminism):-

নারীবাদের তিনটি মুখ্য তরঙ্গের পাশাপাশি আর একটি অন্যতম তরঙ্গ হল নারীবাদের চতুর্থ তরঙ্গ(Fourth Wave Feminism)। এই তরঙ্গের সূত্রপাত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। মূলত Social Networking Site এর উপর ভিত্তি করে এই নারীবাদী তরঙ্গ গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন ওয়েবসাইট, সামাজিক বন্ধুতার সাইট প্রভৃতির মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের, বিভিন্ন সংস্কৃতির নারীরা বিশ্বশান্তি ও ন্যায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। এই চিন্তার প্রধান চালিকা শক্তি হল ‘আধ্যাত্মিকতাবাদ’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুর অধিকার আন্দোলন ও গান্ধীর প্রভাব এই আন্দোলনে প্রত্যক্ষ করা যায়।



নারীবাদের বিভিন্ন ধারা রয়েছে যেমন- 

(১) উদারপন্থী নারীবাদ(Liberal Feminism):-

উদারনৈতিক নারীবাদ বা উদারপন্থী নারীবাদের বৌদ্ধিক অনুপ্রেরণার উৎস ছিল উদারনৈতিক, রাজনৈতিক, দর্শন, যা গড়ে উঠেছিল টমাস হবস, জনলক, জেরেমি বেন্থাম এবং জেমস মিলের উদারনীতিবাদী তত্ত্বের ভিত্তিতে। এই উদারপন্থী নারীবাদের সূচনা ঘটে মেরি উলস্টোনক্র্যাফট এর রচনার মধ্যে দিয়ে। তাঁর গ্রন্থটির নাম হল- A Vindication of the Rights of Women।

তিনি মূলত নারীর ভোটাধিকারের বিষয়টি সর্বসমক্ষে তুলে ধরেন। উদারনৈতিক নারীবাদী তাত্ত্বিকরা মূলত জনজীবনের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। এই নারীবাদ প্রধানত ছিল সংস্কারমূলক প্রকৃতির। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে সমাজে নারীদের অবস্থার অবনতি ঘটে। এইসময় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্বৈরাচার এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও নারীদের আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উদারনৈতিক চিন্তাবিদদের ধ্যানধারণাকে উদারনৈতিক নারীবাদ বলা হয়।

(2) বৈপ্লবিক নারীবাদ(Radical Feminism):-

বৈপ্লবিক নারীবাদের উদ্ভব ঘটেছিল উদারনৈতিক নারীবাদ, মার্ক্সীয় নারীবাদ ও সমাজতান্ত্রিক নারীবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবে। ১৯৬০ এর দশক থেকে বৈপ্লবিক নারীবাদ নারীবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা হিসেবে দেখা যায়। মোটামুটি ভাবে বলা যেতে পারে যে, নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে এই বৈপ্লবিক নারীবাদের ধারণা গড়ে উঠে। এই ধারার নারীবাদীরা মনে করেন যে, পুরুষ প্রাধান্যের ওপর ভিত্তি করে গোটা ওঠা পিতৃতান্ত্রিকতার ধারণা সমাজের এক ক্ষমতার কাঠামো তৈরি করে। এই কারণেই পুরুষের দ্বারা নারীর অবদমন স্থান-কাল-পাত্রের ঊর্ধ্বে।

এই ধারার তাত্ত্বিকরা উদারনৈতিক নারীবাদের মতো পিতৃতন্ত্রকে এক স্বাভাবিক অবস্থা বলে মনে করেন না। এই নারীবাদের তাত্ত্বিকরা বিশ্বাস করেন যে, সমাজে অর্থনৈতিক শ্রেণীভিত্তিক নয়, লিঙ্গভিত্তিক দ্বন্দ্ব হল প্রধান ও প্রাথমিক দ্বন্দ্ব। অনেকের মতে বৈপ্লবিক নারীবাদের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল ফরাসি নারীবাদী সিমোন দ‍্য বোভোয়ার মধ্যে দিয়ে। এই গ্রন্থে তিনি নারীকে চিহ্নিত করলেন সমাজের ‛অপর’ বা ‛other’ হিসেবে।

বোভোয়ার মতে নারীর শারীরিক বৈশিষ্ট্য, সন্তান প্রজনন ও প্রতিপালনের কারণেই নারীর এই ‛অপর’ বা ‛other’ ভূমিকা নির্দিষ্ট হয়। এই ‛otherness’ বা ‛অপরত্ন’ নারীর স্বাধীনতাকে সীমিত করে দেয়, ফলে নারী তার অন্তর্নিহিত ক্ষমতাকে প্রকাশ করতে পারে না। তাই বোভোয়া চেয়েছেন সেইসব প্রক্রিয়া গুলিকে তুলে ধরতে, যা নারীকে ‛অপর’ বা ‛দ্বিতীয় লিঙ্গ’ পরিণত করেছে এবং শেষপর্যন্ত এই ‛অপরত্ন’র অবসান চেয়েছেন তিনি।১৮


বৈপ্লবিক নারীবাদে দুটি গোষ্ঠী মূলত লক্ষ্য করা যায়-(১) বৈপ্লবিক-স্বাধীনতাকামী নারীবাদ, (২) বৈপ্লবিক-সাংস্কৃতিক নারীবাদ। এই বৈপ্লবিক নারীবাদের আলোচনায় আরও সেসমস্ত তাত্ত্বিকদের কথা বলা যায় তাঁরা হলেন- জারমেইন গ্ৰীয়ার, কেট মিলেট, শুলমিথ ফায়ারস্টোন প্রমুখ।

(৩) সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ:-

১৯৬০-৭০ এর দশকে নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা হিসেবে দেখা যায়। মার্ক্সবাদী চিন্তায় বিশ্বাসী এবং একইসঙ্গে মার্ক্সবাদে নারীর অবস্থান সম্পর্কিত শুন্যতাকে পূরণের উদ্দেশ্যেই সমাজতান্ত্রিক নারীবাদের জন্ম।

এই ধারার নারীবাদ নারীর ব্যক্তিপরিসর ও গণপরিসর উভয়ক্ষেত্রেই শোষণের অবসান ঘটিয়ে নারীমুক্তি ঘটাতে চায়। সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ মনে করে পিতৃতান্ত্রিকতা ও পুঁজিবাদ অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উভয়ক্ষেত্রেই শোষণের অবসানের মধ্যে দিয়ে নারীমুক্তি ঘটা সম্ভব। এই নারীবাদের বিখ্যাত স্লোগান ছিল- ‛personal is political’ অর্থাৎ যা ব্যক্তিগত তাই রাজনৈতিক। এই নারীবাদের প্রবক্তারা ছিলেন- জুলিয়েট মিচেল, শীলা রোবোথাম, মিশেল ব‍্যরেট প্রমুখ।

উপসংহার :- 

সর্বপরি বলা যায়, সমাজতত্ত্বের আলোকে নারীবাদের পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করতে গেলে যে বিষয়গুলি যথেষ্ট ভেবে আলোচনা করা আবশ্যক হয়ে পড়ে সেগুলি হল- নারীবাদী সমাজতত্ত্বের ধ্যান-ধারণা, নারীবাদের ধারণা, নারীবাদের উদ্ভব ও বিকাশ, বিভিন্ন তাত্ত্বিকদের অবদান, নারীবাদের বিভিন্ন তরঙ্গ ও ধারা প্রভৃতি।

এছাড়াও এই নারীবাদকে পুরোপুরিভাবে ব্যাখ্যা করতে হলে যে বিষয়গুলির ওপর আলোকপাত করতে হবে সেগুলি হল-পিতৃতন্ত্র, ব্যক্তিপরিসর ও গণপরিসরের মধ্যে বিভাজন, জৈবিক লিঙ্গ ও সামাজিক লিঙ্গের মধ্যে বিভাজন, সমতা ও ভিন্নতা, যৌনতা, নারী ও অর্থনীতি এবং নারীবাদী আন্দোলন প্রভৃতি বিষয়াবলী। এবং নারিবাদকে নিয়ে সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন দেশে যেভাবে চর্চা ও গবেষণা হচ্ছে, তার ফলে নারীবাদের আলোচনার পরিধিও বিস্তার লাভ করছে। নারীবাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন দৃষ্টিকোন।



উপরোক্ত আলোচনা থেকে যে সকল সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় , সেগুলি নিম্নরূপ - 
১. সমাজতত্ত্বের প্রারম্ভিক পর্যায়ে নারীবাদ উপেক্ষিত থাকলেও পরবর্তীকালে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সমাজতত্ত্বের  অন্যতম আলোচ্য বিষয় হিসেবে উপস্থিত হয়। 

২. আধুনিক প্রগতিশীল নারীবাদ ১৯৭০ এর দশকে সমাজবিজ্ঞানের বিষয়গুলিকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করেছিল। সমাজতত্বও এর প্রভাব থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারেনি। 

৩. ঐতিহাসিকভাবে গড়ে ওঠা নানা মতের এক সম্মিলিত শক্তি হল নারীবাদ , যা নারীকে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুরুষের অধীনে বিশেষভাবে পদানত একটি সামাজিক গোষ্ঠী বলে চিহ্নিত করে এবং ওই অবস্থার অবসান করে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। 

৪. নারীবাদকে একটি চিন্তাধারার পাশাপাশি একটি আদর্শ ও আন্দোলনও বলা যায়। এই আদর্শ ও আন্দোলন সমাজে নারীর অবস্থানকে আগের চেয়ে অনেকখানি উন্নত করেছে। 

৫. সমাজতত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে নারীবাদ বা নারী প্রগতিবাদ কথাটি আধুনিক ধারণা হলেও এর মুখ্য বিষয়টি বহু আগে থেকেই চর্চিত। নারীবাদ হল এক সামাজিক আদর্শ ও আন্দোলন যা দীর্ঘদিন ধরে চলা লিঙ্গবৈষম্যজ্ঞাত প্রাধান্য , যা প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল। 

৬. ইতিপূর্বে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে বেশ কিছু বিষয়ে নারীর রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার অর্জনের দাবী তীব্রতর হয়। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নারীর ভোটাধিকারের দাবি গড়ে ওঠে। 

৭. সমাজতত্ত্বে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সংযোজন খুব একটা পুরোনো না হলেও বিভিন্ন নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি , নারীদের সমস্যা , নারী আন্দোলন , নারীদের মর্যাদাগত পরিবর্তন - ইত্যাদি বিষয়গুলি সমাজতত্ত্বে ব্যাপকভাবে আলোচিত ও বিশ্লেষিত হয়েছে। 

৮. বর্তমান সময়ে নারীদের মর্যাদাগত পরিবর্তন ঘটেছে নানাবিধ আন্দোলন , দার্শনিক চিন্তা ও সমাজ সংস্কারের মধ্যে দিয়ে। আধুনিক সমাজতত্ত্বে নারীদের মর্যাদাগত বিবর্তন বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে প্রাধান্য পেয়েছে।    

গ্রন্থপঞ্জি :- 

যে সকল গ্রন্থগুলি প্রকল্পটি রচনায় সহায়ক হয়েছে , সেগুলি হল - 
১. উচ্চমাধ্যমিক সমাজতত্ত্ব - অরুনাংশু প্রধান। 
২. বি এ প্রারম্ভিক সমাজতত্ত্ব - বাণী প্রকাশন। 
৩. ভারতীয় সমাজ - অনাদিকুমার মহাপাত্র। 
৪. ভারতীয় সমাজব্যবস্থা - অনাদিকুমার মহাপাত্র। 
৫. An Introduction to Sociology - Vidyabhusan & Sachdev .    




You May Also Like

0 comments