H.S. Bengali Project
পোস্টমাস্টার গল্পের নাট্যরূপ :-
প্রথম দৃশ্য : -
মঞ্চ - পরিকল্পনা :- একটি সাধারণ মঞ্চ। মৃদু , কম্পমান বাতির আলো। ঘরে একটি চারপেয়ে। মঞ্চের একপাশে রান্নার জন্য কিছু বাসন ও একটি উনুন।
দৃশ্যের শুরুতে দেখা যায় পোস্টমাস্টার মঞ্চের খাটিয়াতে বসে আছেন , অস্থির বোধ করছেন। কিছুটা বিরক্ত।
পোস্টমাস্টার : আমার অবস্থা কেমন জানেন তো ! জলের মাছকে ডাঙায় তুললে যেমন হয় , এই গন্ডগ্রামের মধ্যে এসে আমার অবস্থাও ঠিক সেইরকম। ………. গ্রামটি অতি সামান্য , উলারপুর গ্রাম। চাকরিটা পেয়ে পোস্টমাস্টার হিসাবে আমাকে প্রথমেই এই গ্রামে আসতে হয়। কাজ যদিও বিশেষ কিছু নেই , কবিতা - টবিতা লেখার সময়ও পাই ; কিন্তু কেন জানি না গ্রামটার সাথে আমি ঠিক মানিয়ে নিতে পারছি না। আসলে ঝাঁ চকচকে কলকাতা শহরে থেকে অভ্যস্থ আমার মতো একজনের পক্ষে হঠাৎ করে এইরকম একটা গন্ডগ্রামে মানিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।
[ খাটিয়া থেকে উঠে পাশে রাখা কলসি থেকে জল ঢেলে একটু পান করলো। ]
খুব ভালো হত , যদি আরব্য উপন্যাসের কোনো দৈত্য এসে এক রাতের মধ্যে এই শাখাপল্লব সমেত সমস্ত গাছগুলো কেটে পাকা রাস্তা বানিয়ে দেয় এবং সারি সারি অট্টালিকা চারপাশে গড়ে ওঠে তাহলে আমার মত আধমরা এই ভদ্রসন্তানটি পুনচ্চঃ নবজীবন লাভ করতে পারে।
তাও ভালো , একটি কাজের মেয়ে পাওয়া গেছে। রতন। বয়স বারো তেরো। পিতৃমাতৃহীন অনাথা বালিকা। এই বালিকা আমার কাজকর্ম করে দেয় , বদলে চারটি খেতে পায়। ওর বিবাহের বিশেষ সম্ভাবনা তো দেখতে পাচ্ছি না।
রতন …………. এই রতন ……...একবার এদিকে আয় তো ………
[ রতন মঞ্চে প্রবেশ করলো। ]
রতন : কী গো বাবু , কেন ডাকছো ?
পোস্টমাস্টার : তুই কী করছিস ?
রতন : এই তো এখনই হেঁসেলের চুলো ধরাতে হবে।
পোস্টমাস্টার : তোর হেঁসেলের কাজ পরে হবে এখন ……. একবার তামাকটা সেজে দে তো।
[ রতন প্রস্থান করলো এবং অনতিবলম্বে দুটি গাল ফুলিয়ে কলকে তে ফুঁ দিতে দিতে রতন পুনরায় মঞ্চে প্রবেশ করলো। রতনের হাত থেকে কলকেটি পোস্টমাস্টার নিজের হস্তগত করলো। ]
পোস্টমাস্টার : আচ্ছা রতন , তোর মাকে মনে পড়ে ?
রতন : সে অনেক কথা। কতক মনে পড়ে , কতক মনে পড়ে না। মায়ের চেয়ে বাপ আমায় বেশি ভালোবাসতো। বাপকে অল্প অল্প মনে আছে। সারাদিন পরিশ্রম করে বাপ সন্ধ্যাবেলা ঘরে ফিরে আসতো। [ কথাগুলো বলতে বলতে রতন পোস্ট মাস্টারের পায়ের কাছে গিয়ে বসে পড়ে। ] আর আমার এক ছোট ভাই ছিল। আমরা দুইজনে মিলে বর্ষার দিনে ডোবার ধারে ভাঙা ডালকে ছিপ করে মিছিমিছি মাছ ধরা খেলা খেলতাম। এই কথাগুলো কিছু কিছু মনে পড়ে।
[ কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। ]
পোস্টমাস্টার : বাদ দে রতন আজকে আর রান্না করতে হবে না। সকালের বাসি খাবার তো আছেই। কয়েকটা রুটি সেঁকে দে তাহলেই হবে।
[ পোস্টমাস্টার এবং রতন মঞ্চে উপবিষ্ট। ]
পোস্টমাস্টার : জানিস রতন , আমারও বাড়ির কথা মনে পড়ে। খুব মনে পড়ে। ছোটভাই , মা আর দিদির কথা। ………… এই জনহীন , সঙ্গীহীন , বন্ধুহীন প্রবাসে যদি তারা কেউ থাকতো , নিজের যদি কেউ থাকতো , স্নেহ করার জন্য মায়ের মতো কেউ থাকতো ……. তাহলে নিজেকে এতটা অসহায় লাগতো না।
[ রতন এবং পোস্টমাস্টার দুজনেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ]
পোস্টমাস্টার : ছাড় এসব কথা। অন্য একটা কথা বলি। …….. বলছি তোর কি পড়াশোনা কিছু শেখা আছে ?
রতন : না গো দাদাবাবু।
পোস্টমাস্টার ( উৎসাহ পেয়ে ) : শোন্ রতন , তোকে আমি প্রতিদিন একটু একটু করা পড়তে শেখাবো পড়বি তো ?
রতন : হ্যাঁ , দাদাবাবু।
তৃতীয় দৃশ্য : -
[ রতন খাটিয়ার উপর শুয়ে আছে। রতন ধীরে ধীরে মঞ্চে প্রবেশ করলো। হাতে খাবারের থালা। ]
রতন : কী হয়েছে দাদাবাবু , এসময় শুয়ে আছো যে ! ঘুমোছিলে ?
পোস্টমাস্টার ( ক্লান্ত কণ্ঠে ) : শরীরটা ভালো বোধ হচ্ছে না। দেখ তো আমার কপালে হাত দিয়ে।
[ রতন দ্রুত খাবারের থালা পাশে রেখে পোস্টমাস্টারের কপালে হাত দিল। ]
রতন ( উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ) : এ কী দাদাবাবু , তোমার যে জ্বর ! গা যে একেবারে পুড়ে যাচ্ছে গো।
[ একথা বলে রতন একবাটি জল ও একটি ন্যাকড়া নিয়ে পোস্টমাস্টারের কপালে জলপট্টি দিতে শুরু করলো। কিছুক্ষন পর পর জিজ্ঞেস করতে থাকলো - ‘’ হ্যাঁ গো দাদাবাবু , একটুখানি ভালো বোধ হচ্ছে কি ? ]
পোস্টমাস্টার ( কাতর কণ্ঠে ) : জানিস রতন , মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। এসময় মা পাশে থাকলে খুব ভাল হত। …………. তুই ……… তুইও না ঠিক মায়ের মতো ……… স্নেহময়ী।
চতুর্থ দৃশ্য : -
পোস্টমাস্টার : নাহঃ , এভাবে আর চলতে পারে না। …….. আজই আমি স্থানীয় অস্বাস্থ্যের কথা উল্লেখ করে কলকাতার কর্তৃপক্ষের নিকট বদলির জন্য দরখাস্ত করবো। ……….. না দরখাস্ত করেই আসি।
[ পোস্টমাস্টার মঞ্চ ত্যাগ করলো এবং কিছুক্ষন পরেই আবার ফিরে এল। ]
পোস্টমাস্টার : রতন ……… এই রতন …….. একবার এদিকে আয় তো ……
[ রতন মঞ্চে প্রবেশ করে। ]
পোস্টমাস্টার : শোন , আমি কলকাতার কর্তৃপক্ষের কাছে বদলির আবেদন করেছিলাম। কিন্তু দরখাস্ত নাকচ হয়ে গেছে। তাই আমি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে দিয়েছি। তাই কাল’ই আমি চলে যাচ্ছি।
রতন : কোথায় যাচ্ছ , দাদাবাবু ?
পোস্টমাস্টার : বাড়ি যাচ্ছি।
রতন : আবার কবে আসবে ?
পোস্টমাস্টার : আর আসবো না।
[ রতনের মুখ কালো হয়ে এল। সমস্ত আনন্দ মুছে গেল মুখ থেকে। কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর রতন রান্না করার উদ্যোগ করতে শুরু করলো।
রতন : দাদাবাবু , আমাকে তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে ?
পোস্টমাস্টার : সে কী করে হবে ! ( কথাটা বলার সময় পোস্টমাস্টার যেন একটু বেদনা অনুভব করলো। )
[ রতন কিছু না বলে চুপচাপ রান্নার উদ্যোগ করছে। কিছুক্ষন পর …. ]
পোস্টমাস্টার : শোন রতন , আমার জায়গায় যে লোকটি আসবেন তাঁকে বলে দিয়ে যাব , তিনি তোকে আমারই মতন যত্ন করবেন। ………. আর এই নে ( জামার পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে ) তোকে আমি কখনো কিছু দিতে পারিনি। আজ যাবার সময় ক’টা টাকা তোকে দিয়ে গেলাম , এতে তোর কদিন চলবে।
[ হঠাৎ রতন রান্না ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে সরাসরি পোস্টমাস্টারের পায়ে লুটিয়ে পড়ে। ]
রতন ( কাঁদতে কাঁদতে ) : না না তোমার কাউকে কিছু বলতে হবে না , আমি আর এখানে থাকতে চাই নে ………… আর দাদাবাবু , তোমার দুটি পায়ে পড়ি , আমাকে কিছু দিতে হবে না। আমার জন্য কাউকে কিছু ভাবতে হবে না।
[ একথা বলে উচ্ছসিত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে রতন এক দৌড়ে মঞ্চ থেকে প্রস্থান করলো। পোস্টমাস্টার কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো , তারপর যেন নিজেকেই স্বান্তনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলে উঠল ……. ]
পোস্টমাস্টার : হায় বুদ্ধিহীন মানব হৃদয় ! মিথ্যা আশাকে দুই বাহুবন্ধনে বেঁধে মানুষ সত্য বলে মনে করে। এক ভ্রান্তি থেকে এক ভ্রান্তিতে জড়িয়ে পড়া মানবের চিরকালের অভ্যাস। ……….. কিন্তু সত্যিই খুব ইচ্ছা হয় ……… খুব ইচ্ছা হয় ……. এই অনাথিনীকে সঙ্গে করে নিয়ে যাই ……….. কিন্তু কি লাভ ! জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ আছে , মৃত্যু আছে ………. পৃথিবীতে কে কার !
[ ধীরে ধীরে যবনিকা পতন। ]